৮ জেলার ৩৫টি স্থানে বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। মেরামতের পর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বালুর বস্তা দেওয়া হয়নি।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে উপকূলীয় আটটি জেলার প্রায় ৩০০টি স্থানে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। এসব জেলার প্রায় চার কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ ভেঙে পানিতে ভেসে গেছে। কমপক্ষে ৩৫টি স্থানে বাঁধ উপচে বসতি এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকা থেকে পানি বের হচ্ছে না, তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। আরও ২২টি স্থানে বাঁধ প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে।
পাউবোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাঁধ ভেঙে ও উপচে পানি প্রবেশ করে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে মূলত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, ভোলার চরফ্যাশন, খুলনার পাইকগাছা ও দাকোপে। সাতক্ষীরার গাবুরায় উঁচু জোয়ারের পানি বাঁধ টপকে বসতি এলাকা প্লাবিত করেছে। এসব এলাকার বেশির ভাগ বাঁধ ষাটের দশকে তৈরি করা। বাঁধগুলোর উচ্চতা ৬ থেকে ৮ ফুট, যা অন্য এলাকা থেকে কম। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর আটটি উপকূলীয় জেলায় বেড়িবাঁধ উঁচু করা কিছু কিছু এলাকায় তা করা হয়নি। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার পানি ওঠার পর পানি গ্রামে প্রবেশ করে।
উল্লেখ্য, উপকূলীয় জেলাগুলোতে মোট বাঁধের আয়তন ৫ হাজার ৮০০ কিলোমিটার।
তবে বাঁধবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে দেখা দিয়েছে স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দ্রুত মেরামত না হওয়া। কারণ, জোয়ার–ভাটার পানি ওই ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবেশ করছে। এতে বাঁধের ফাটা অংশ আরও বড় হচ্ছে। সময় যত যাবে, বাঁধের ফাটল আরও বড় হলে মেরামতের খরচও বাড়বে। দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলীয় এলাকায় অনেক জায়গায় বাঁধের চেয়ে জোয়ারের উচ্চতা বেশি থাকায় বসতি ও কৃষিজমিতে পানি প্রবেশ করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় ঠিকাদারদের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে বাঁধ দুর্বল ছিল। অনেক জায়গায় ঠিকমতো মেরামত হয়নি। ফলে বাঁধ ভেঙেছে, আবারও ভাঙতে পারে। ফলে বেড়িবাঁধগুলো মেরামতে সুশাসনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত করতে গিয়ে কয়েকটি স্থানে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। কয়রা ও পাইকগাছায় জনপ্রতিনিধি, পাউবোর ঠিকাদার ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় মেরামত কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে এসব বাঁধ মেরামতের কাজ বিলম্বিত হয়। এতে বাঁধের ফাটল আরও বড় হয়। মেরামতের পর কয়রাসহ কয়েকটি এলাকায় বাঁধ আবারও ভেঙে গেছে।
পাউবো ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পাইকগাছায় ঘূর্ণিঝড়ের রাতে বাঁধের ১০ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দেয়। স্থানীয় লোকজন ও পাউবোর ঠিকাদারেরা বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করেন। কিন্তু বাঁধ মেরামত করতে গিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা–কাটাকাটি হয়। এতে ঠিকাদার ও দেলুটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের অনুসারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে মেরামত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুই দিনের মাথায় বাঁধের ভাঙা অংশ বড় হয়ে ৫০ মিটার হয়।
কয়রা ও পাইকগাছায় জনপ্রতিনিধি, পাউবোর ঠিকাদার ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় মেরামত কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে এসব বাঁধ মেরামতের কাজ বিলম্বিত হয়।
এ ব্যাপারে দেলুটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিপন মন্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠিকাদারেরা একটি ভেকু মেশিন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। আমরা তিনটি ভেকু চাওয়ায় তারা দিচ্ছিল না। ফলে আমরা বাধা দেই। যে কারণে একটু দেরিতে হলেও তারা আরও দুটি ভেকু মেশিন নিয়ে এসে কাজ শুরু করে। তবে এখন সমস্যা মিটে গেছে।’
দলীয় কোন্দল ও ঠিকাদারি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে বাঁধ মেরামতে একই ধরনের সমস্যা হয় খুলনার কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিনের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন ও বর্তমান কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে মেরামতের কাজের ঠিকাদারি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামতের জন্য বালু সরবরাহ নিয়ে মূলত ওই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। বাঁধের ভাঙা অংশের পেছনে রিং বাঁধ নির্মাণের জায়গা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয় অধিবাসীরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ওই বাঁধ মেরামত করেন। পাউবোর দায়িত্ব ছিল ওই বাঁধের দুই পাশে বালুর বস্তা ও বালুর টিউব দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু ওই বালু ও শ্রমিক সরবরাহ নিয়ে আওয়ামী লীগের ওই দুই নেতার অনুসারী ঠিকাদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফলে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধের কাজ শেষ করার পর তা আবার ভেঙে যায়। বালু ও শ্রমিক সরবরাহ নিয়ে ওই দুই নেতা একে অপরকে দুষছেন।
ঠিকাদারেরা একটি ভেকু মেশিন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। আমরা তিনটি ভেকু চাওয়ায় তারা দিচ্ছিল না। ফলে আমরা বাধা দেই। যে কারণে একটু দেরিতে হলেও তারা আরও দুটি ভেকু মেশিন নিয়ে এসে কাজ শুরু করে। তবে এখন সমস্যা মিটে গেছে।দেলুটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিপন মন্ডল
এ ব্যাপারে জেলা পরিষদ সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার তিন শতাধিক লোক নিয়ে মঙ্গলবার সকালে আমরা বাঁধ মেরামত কাজ শুরু করি। কথা ছিল মাটির কাজ শেষ হলে পাউবো বালুভর্তি টিউব সরবরাহ করবে। সে অনুযায়ী পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী সোলায়মান আলী বালু সরবরাহ নিয়ে কথা বলেন জাহাঙ্গীর নামের স্থানীয় একজন ড্রেজার মালিকের সঙ্গে। দুপুরে বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ শেষ করার পর এর দুই পাশে বালুভর্তি টিউব দিয়ে সুরক্ষিত করার কথা। কিন্তু ড্রেজার মালিক শেষ মুহূর্তে বালু সরবরাহে অস্বীকৃতি জানান। ওই ড্রেজার মালিক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।’
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে এস এম শফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
পাউবো খুলনা–২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পর আমরা স্থানীয়দের সহায়তায় মেরামতের কাজ শুরু করি। তবে ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কিছু সমস্যা হওয়ায় কয়েকটি জায়গায় কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। তবে এখন সমস্যা মিটে গেছে। বেশির ভাগ জায়গায় আমরা প্রাথমিক মেরামত শুরু করেছি। আশা করি বাকিগুলো দ্রুত শেষ করে আনব।’
বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামতের জন্য বালু সরবরাহ নিয়ে মূলত ওই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। বাঁধের ভাঙা অংশের পেছনে রিং বাঁধ নির্মাণের জায়গা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয় অধিবাসীরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ওই বাঁধ মেরামত করেন। পাউবোর দায়িত্ব ছিল ওই বাঁধের দুই পাশে বালুর বস্তা ও বালুর টিউব দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয় থেকে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বৃহস্পতিবার সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে পিরোজপুর, খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, ভোলা ও বরিশালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ৫০ হাজার মাছের ঘের, ৩৪ হাজার পুকুর এবং চার হাজার কাঁকড়ার খামার প্লাবিত হয়েছে। সেখান থেকে মাছ ও কাঁকড়া ভেসে চলে গেছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। আর গ্রামীণ পুকুরের মধ্যে আটটি জেলায় ৩০ হাজার ৩০১টি পুকুর লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার খাওয়ার পানির প্রধান উৎস ১৬ হাজার ৫০০টি নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।
জলাবদ্ধতার কারণে গর্ভবতী নারীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন। তাঁরা জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা নিতে হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে পারছেন না। প্রতিবেদনে পটুয়াখালীর গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলার মোট ৭০০ নারী চিকিৎসা নিতে না পারায় বিপদে পড়েন বলে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ৫০ হাজার মাছের ঘের, ৩৪ হাজার পুকুর এবং চার হাজার কাঁকড়ার খামার প্লাবিত হয়েছে। সেখান থেকে মাছ ও কাঁকড়া ভেসে চলে গেছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, কোথাও যদি বাঁধ না থাকে, তাহলে মানুষ জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রস্তুতি নিতে পারে। এলাকা ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু দুর্বল বাঁধ মানুষকে জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির ব্যাপারে ভুল বার্তা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের কারণে উপকূলের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এই সামগ্রিক ক্ষতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।