চিকিৎসকেরা বলছেন, প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা গেলে ৯০ শতাংশ রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন রোকসানা (৩১)। চোখেমুখে অসুস্থতার ছাপ তীব্র। এই প্রতিবেদক কথা বলার জন্য পাশে বসলে জানালেন, তিন মাস আগে তাঁর ডান স্তনে ক্যানসার ও গর্ভাশয়ে টিউমার শনাক্ত হয়।
রোববার রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কথা হয় রোকসানার সঙ্গে। ওই দিন কেমোথেরাপির জন্য সময় নিতে এসে পাননি। রোকসানা বললেন, যত দেরিই হোক, সরকারি হাসপাতালেই তাঁকে থেরাপি নিতে হবে। ‘খালি টেস্ট, খালি টেস্ট’, খরচ কুলাতে পারছেন না তিনি।
একই হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় কুড়িগ্রামের মোসাম্মৎ রাবেয়ার (৪২) সঙ্গে। এক মাসের মধ্যে তাঁর রেডিওথেরাপি শুরুর প্রয়োজন থাকলেও সিরিয়াল পেতে তিন মাস লেগে গেছে। তিনি বিভিন্ন অফিসে ঘুরে দুই লাখ টাকা সাহায্য তুলে চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন। একাই তাঁকে চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয়। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলছিলেন, ততক্ষণ কাঁদছিলেন তিনি।
প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে ও সময়মতো পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারলে ৯০ শতাংশ রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব।জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার
অপ্রতুল সেবাব্যবস্থা আর ব্যয়বহুল চিকিৎসার এই চিত্রের মধ্যে আজ ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) সর্বশেষ ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, আক্রান্তের দিক দিয়ে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের অবস্থান তৃতীয়। প্রতিবছর বাংলাদেশে নতুন করে আনুমানিক ১৩ হাজার ২৮ জনের স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয়। নতুন ও পুরোনো রোগী মিলিয়ে বছরে মারা যান ৬ হাজার ৭৮৩ জন।
চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্যানসারের উপসর্গ দেখা না দিলে রোগীকে ক্যানসারজয়ী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে বছরে স্তন ক্যানসারজয়ী ঘোষিত হন ৩১ হাজার ২৩২ জন।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রের পাঁচটি গত এক বছর ধরে নষ্ট ছিল। ১০ বছর মেয়াদের যন্ত্র ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে চালানো হয়েছে। একটি যন্ত্র মেরামত করে গত সপ্তাহে চালু করা হয়েছে। ফলে কম খরচে রেডিওথেরাপি দিতে আসা রোগীরা সিরিয়াল না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
হাসপাতালে বিভিন্ন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যাপ্ত যন্ত্র না থাকা ও রেডিওথেরাপি যন্ত্র বিকল থাকায় বেশির ভাগ রোগীকে ক্যানসার চিকিৎসার কোনো না কোনো সেবা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিতে হয়েছে। জমি বিক্রি করে, পরিবারের সদস্য বা বাইরের লোকজনের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা ব্যয় চালাতে হচ্ছে তাঁদের। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যানসার চিকিৎসার ৫০–৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়।
অথচ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রের পাঁচটি গত এক বছর ধরে নষ্ট ছিল। ১০ বছর মেয়াদের যন্ত্র ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে চালানো হয়েছে। একটি যন্ত্র মেরামত করে গত সপ্তাহে চালু করা হয়েছে। ফলে কম খরচে রেডিওথেরাপি দিতে আসা রোগীরা সিরিয়াল না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক দুটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র কেনা হয়েছে। এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ যন্ত্র এসে পৌঁছাবে। আগামী বছর আরও দুটি যন্ত্র কেনা হবে। তিনি জানান, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ রোগী আসেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ স্তন ক্যানসারের রোগী।
তিন বছর আগে তাঁর বাম স্তনে ক্যানসার শনাক্ত হলেও টাকা জোগাড় করতে না পারায় চিকিৎসা শুরু করতে দেড় বছর দেরি হয়েছে। রংপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয়টি কেমোথেরাপি দিয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়।মোসাম্মৎ রাবেয়া
রোকসানা জানান, তিনি পাবনার বেড়া উপজেলায় থাকেন স্বামী ও শিশু সন্তান নিয়ে। স্বামী বেকার। চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জে ভাইয়ের বাসায় উঠেছেন। এই হাসাপাতালেই অস্ত্রোপচারে টিউমার অপসারণ করেছেন। স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির দ্রুত সিরিয়াল না পেয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৬০ হাজার ৫০০ টাকায় ১০টি থেরাপি নিয়েছেন।
হাসপাতালে থাকলে ৫ হাজার টাকা লাগবে, তাই ব্যয় কমাতে প্রতিদিন ১ হাজার ৬০০ টাকায় মাইক্রোবাস ভাড়া করে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসতেন। বাবা কৃষিজমি বিক্রি করে আর ভাইয়েরা মাসের বেতন থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করছেন। তাঁর আফসোস, শিক্ষিত হয়েও তিনি অবহেলা করেছেন। ডান স্তনে তিনি চাকা অনুভব করেও চিকিৎসকের কাছে যাননি। এখন ভুগছেন।
এদিকে মোসাম্মৎ রাবেয়া জানালেন, তিন বছর আগে তাঁর বাম স্তনে ক্যানসার শনাক্ত হলেও টাকা জোগাড় করতে না পারায় চিকিৎসা শুরু করতে দেড় বছর দেরি হয়েছে। রংপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয়টি কেমোথেরাপি দিয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়। মহাখালীর ৫০০ শয্যার ক্যানসার হাসপাতালে তিনটি কেমোথেরাপিতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। কেমোথেরাপির ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। রেডিওথেরাপি বিনা মূল্যে পাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তানকে বুকের দুধ পান না করালে, পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে, কম বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণ করলে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে, অতিরিক্ত ওজন থাকলে, ধূমপান ও তামাকের ব্যবহারে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। স্তনে চাকা, স্তনের বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া, চামড়া কুঁচকে যাওয়া, স্তনের বোঁটা দিয়ে রক্ত ঝরা স্তন ক্যানসারের লক্ষণ।
ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে ‘বাংলাদেশে ক্যানসার সেবায় অর্থায়ন: বিকল্প পথ’ শিরোনামের একটি গবেষণা ২০২১ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সায়েন্সেস–এ প্রকাশিত হয়। ২৬২ জন ক্যানসার রোগীর ওপর গবেষণা করা হয়, যার মধ্যে স্তন ক্যানসারের রোগী ছিলেন ৩০ জন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কাঠামোগত কোনো অর্থনৈতিক পদ্ধতি না থাকায় বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যানসার রোগের চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার, থেরাপি, বিভিন্ন পরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ফি, ওষুধ, ইনজেকশন, যাতায়াত, হাসপাতালে থাকা, রোগীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তির জন্য খরচ বাবদ দেশে বছরে একজন ক্যানসার রোগীর খরচ হয় ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৫ টাকা। অস্ত্রোপচার, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি তিনটিই সরকারি হাসপাতালে নিলে রোগীর খরচ হয় ২ লাখ টাকা। কোনো একটি চিকিৎসা বা সবটুকু চিকিৎসা বেসরকারি হাসপাতালে নিলে খরচ অনেক বেড়ে যায়।
ওই গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গবেষণাটি যখন হয়েছিল, তখনকার চেয়ে এখন ব্যয় আরও বেড়েছে। তাই সরকারি হাসপাতালে বেশি সংখ্যক রোগীর সেবাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আটটি বিভাগে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করছে সরকার। সেসব হাসপাতালে যথাযথ সেবা দিতে এখন থেকেই দক্ষ ক্যানসার চিকিৎসক ও জনবল প্রস্তুত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে।
সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ক্যানসারসহ দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় সরকারের একটি তহবিল গঠন করা দরকার। যেখানে সরকারের পাশাপাশি অংশীজন ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থ এবং কর বাড়িয়ে তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নেওয়া হবে। বছরে একজন রোগীর চিকিৎসায় সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে ওই তহবিল থেকে।
গোলাপি রংকে থিম ধরে অক্টোবর মাসকে স্তন ক্যানসারে সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, জায়গায় জায়গায় গোলাপি বেলুন দিয়ে সাজানো এবং মানুষকে সচেতন করার বিভিন্ন বার্তা লেখা। বিনা মূল্যের স্ক্রিনিং (পরীক্ষা) কর্মসূচি চলছে। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৪৫ জন নারী স্ক্রিনিং করেছেন।
হাসপাতালের গাইনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাহানা পারভীন বলেন, স্তন নিজে পরীক্ষা করা ও চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের আরও সচেতন হতে হবে। অবস্থা খারাপ হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে আসেন বেশির ভাগ নারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তানকে বুকের দুধ পান না করালে, পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে, কম বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণ করলে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে, অতিরিক্ত ওজন থাকলে, ধূমপান ও তামাকের ব্যবহারে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। স্তনে চাকা, স্তনের বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া, চামড়া কুঁচকে যাওয়া, স্তনের বোঁটা দিয়ে রক্ত ঝরা স্তন ক্যানসারের লক্ষণ।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে ও সময়মতো পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারলে ৯০ শতাংশ রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব।
তবে সংকোচের কারণে নারীরা স্ক্রিনিংয়ে পিছিয়ে থাকেন। ফলে তিন-চতুর্থাংশ রোগ ধরা পড়ে রোগের শেষ পর্যায়ে। স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার—এই তিনটির জন্য সমন্বিত জাতীয় স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার।