গ্রীষ্মে অতি উষ্ণতার বিপদ

নতুন গবেষণার তথ্য বলছে, অতি উষ্ণ তাপমাত্রার ঝুঁকিতে বাংলাদেশের গ্রামের ৩৭.৫ শতাংশ এবং ঢাকার ৫৩ লাখ মানুষ।

সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিল মাসটি ছিল দেশের ইতিহাসে অন্যতম উষ্ণ মাস। মাসটিতে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা ছিল ২ ডিগ্রি বেশি। বৃষ্টি কম হয়েছে ৬৬ শতাংশ। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের কোথাও কোথাও বৃষ্টি হলেও দিনে গরমের কষ্ট কমেনি। বর্ষার আগের এই সময়ে এখন আবার তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালের গরম রীতিমতো আপদ (হ্যাজার্ড) থেকে দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে।

গবেষকেরা বলছেন, অতি উষ্ণ তাপের মধ্যে কেউ যদি টানা ছয় ঘণ্টা থাকেন, তাহলে তাঁর শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। এমনকি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে।

সাম্প্রতিক দুটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের জন্য গ্রীষ্মকাল বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই মৌসুমে উষ্ণতম দিনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৬৬ শতাংশ মানুষ ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার বা অতি উষ্ণ তাপমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছেন। ১৯৭৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতি এক দশকে গ্রীষ্মকালে এ ধরনের দিনের সংখ্যা এক থেকে তিন দিন করে বাড়ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্ব এলাকায় এ ধরনের তাপমাত্রা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

কোনো এলাকার তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে এবং তা যদি ছয় ঘণ্টা স্থায়ী হয়, তবে এমন অবস্থাকে অতি উষ্ণ তাপমাত্রা বলা হয়।

বিশ্বের কয়েকটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে কাজটি করেছে, তা আমরা শুনেছি। তবে দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও বাংলাদেশের জন্য ওই অতি উষ্ণ তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তা পেলে আমরা সম্মিলিতভাবে ওই পূর্বাভাসও দিতে পারব
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূঁইয়া
গরমে অতিষ্ঠ মানুষ

গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ গ্রীষ্মকালে তীব্র গরমের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। আর দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় এই বিপদ সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। এখানকার ৫৩ লাখ মানুষ গরমের সময়ে বাইরে কাজ করতে বের হন। গ্রাম ও শহরের ওই অধিবাসীরা অতি উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে গেছেন।

এমন অবস্থায় গাছ লাগানো, শহরের বিভিন্ন স্থানে পানির কল স্থাপন, প্রতিটি এলাকায় একটি করে বৃক্ষ আচ্ছাদিত পার্ক তৈরি ও জলাভূমি সংরক্ষণের সুপারিশ করেছেন গবেষকেরা।

গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দক্ষিণ এশিয়ার ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে এ ধরনের তাপমাত্রা বাড়ছে। গোটা বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও তাপের তীব্রতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশে তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে কাজ করা গবেষণা দলের প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এত দিন বাংলাদেশে দুর্যোগ বলতে বেশি আলোচনা করতাম ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা নিয়ে। ফলে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ওই দুটি দুর্যোগকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। কিন্তু বজ্রপাতের মতোই গ্রীষ্মকালীন অতিরিক্ত উষ্ণতা আমাদের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগে (স্লো অনসেট ডিজাস্টার) পরিণত হতে যাচ্ছে। আমরা শুধু শহরের তাপমাত্রা নিয়ে বেশি চিন্তা করি। কিন্তু ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর পাশাপাশি গ্রামের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে ওই গরমের মধ্যে জমিতে কাজ করতে হয়। ফলে তাঁরাও ওই উষ্ণতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আমাদের সামগ্রিকভাবে শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গ্রাম নিয়েও ভাবতে হবে।’

অতি উষ্ণ তাপমাত্রার ব্যাখ্যা

গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, ষাটের দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরা গরমের মধ্যে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তখন দেশটির বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো গরমে মানুষের কষ্ট ও ঝুঁকি বোঝার চেষ্টা করেন। এ জন্য তাঁরা উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি আর্দ্রতা, বাতাসের প্রবাহ, কোনো একটি এলাকায় কত সময় ধরে বেশি উষ্ণতা থাকছে তার সময়কাল এবং সূর্যকিরণ কোন দিক থেকে আসছে—এসব কিছু বিবেচনায় নেন। সম্মিলিতভাবে আবহাওয়ার ওই সব কটি অবস্থা মিলিয়ে একটি সূচক তৈরি করেন, যার নাম দেওয়া হয় ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার বা অতি উষ্ণ তাপমাত্রা। একজন মানুষের ওপর ওই তাপ কতটুকু পড়ছে এবং তাঁরা কীভাবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা বোঝার জন্য সূচকটির ব্যবহার শুরু করেন তাঁরা।

পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের নির্মাণশ্রমিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরে এর প্রভাবের বিষয়টি সামনে আসে। অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও ওই উষ্ণ আবহাওয়ার বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। দেশগুলোর আবহাওয়া বিভাগ থেকে এ তাপমাত্রার বিষয়টিকে আলাদাভাবে পূর্বাভাস ও পর্যবেক্ষণে নিয়ে আসা হয়।

চলতি বছর প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় ওই অতি উষ্ণ তাপমাত্রার ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা হয়।

আমরা এত দিন বাংলাদেশে দুর্যোগ বলতে বেশি আলোচনা করতাম ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা নিয়ে। ফলে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ওই দুটি দুর্যোগকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। কিন্তু বজ্রপাতের মতোই গ্রীষ্মকালীন অতিরিক্ত উষ্ণতা আমাদের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগে (স্লো অনসেট ডিজাস্টার) পরিণত হতে যাচ্ছে। আমরা শুধু শহরের তাপমাত্রা নিয়ে বেশি চিন্তা করি। কিন্তু ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর পাশাপাশি গ্রামের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে ওই গরমের মধ্যে জমিতে কাজ করতে হয়। ফলে তাঁরাও ওই উষ্ণতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আমাদের সামগ্রিকভাবে শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গ্রাম নিয়েও ভাবতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল

গত মার্চে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সাসটেইনেবল সিটিস অ্যান্ড সোসাইটিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীরা কী পরিমাণে তাপের চাপে আছেন এবং এর সময় ও এলাকাভিত্তিক প্রভাব নিয়ে ‘স্পেসোটেমপোরাল চেঞ্জেস ইন পপুলেশন এক্সপোজার টু হিট স্ট্রেস ইন সাউথ এশিয়া’ শিরোনামে গবেষণাটি করা হয়।

মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক শামসুদ্দিন শহিদ ও আং কাইয়ো কাইয়ো, মিসরের আরব একাডেমি অব সায়েন্সের গবেষক মোহাম্মদ মাগদি হামিদ ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন।

গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দক্ষিণ এশিয়ার ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে এ ধরনের তাপমাত্রা বাড়ছে। গোটা বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও তাপের তীব্রতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে।

দুটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকা শামসুদ্দিন শহিদ বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে গ্রীষ্মকালে গরম বেড়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে এখনো আমরা ওই ঝুঁকির বিষয়টি চিহ্নিত করিনি। এই গবেষণার মাধ্যমে বিষয়টির সূত্রপাত হলো। বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পরামর্শ ও পূর্বাভাসের পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। যেমন রাস্তার পাশে প্রচুর গাছ লাগানো, পানির কল রাখা, জলাধার সংরক্ষণ ও প্রতিটি এলাকায় একটি করে বৃক্ষ আচ্ছাদিত পার্ক তৈরি করা। আমাদেরকেও তা করতে হবে।’

বাংলাদেশের তাপমাত্রা কোন দিকে যাচ্ছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল ও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক শামসুদ্দিন শহিদ ও আবুল কাশেম ফারুকি ফাহিম যৌথভাবে বাংলাদেশে অতি উষ্ণ তাপের প্রভাব নিয়ে গবেষণাটি করেছেন। ‘চেঞ্জেস ইন ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার অ্যান্ড রিস্ক টু হিট রিলেটেড হ্যাজার্ড: অ্যান ওভারভিউ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে কৃষিশ্রমিক এবং শহরের দিনমজুরেরা এ ধরনের তাপের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। তাঁদের জন্য সঠিক পূর্বাভাস এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, তার পরামর্শ ও সহায়তা দিতে হবে। নয়তো এই উষ্ণতা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য বড় ধরনের দুর্যোগে পরিণত হবে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর কী করছে?

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জনগণের জন্য সাধারণত যে পূর্বাভাস ও পর্যবেক্ষণ তাদের ওয়েবসাইটে দেয়, সেখানে অতি উষ্ণ তাপমাত্রা সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকে না। তারা মূলত তাপমাত্রার পরিমাপ, বাতাসে আর্দ্রতা কত শতাংশ ও সূর্যকিরণ কত সময় ধরে থাকবে—এসব তথ্য আলাদাভাবে দেয়। তবে সংস্থাটির কয়েকজন গবেষক ওই ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার বা অতি উষ্ণ তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন।

আকু ওয়েদার, ওয়েদার অনগ্রাউন্ড, উইন্ডিসহ আবহাওয়াবিষয়ক বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থাগুলো বিশ্বের বেশির ভাগ এলাকার তাপমাত্রার পরিমাপ দিয়ে থাকে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা আলাদাভাবে অতি উষ্ণ তাপমাত্রার পূর্বাভাসও দেয়। যাতে নাগরিকেরা এ ধরনের আবহাওয়া কোথায়, কখন ও কতক্ষণ ধরে থাকবে, তা বুঝতে পারেন।

জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের কয়েকটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে কাজটি করেছে, তা আমরা শুনেছি। তবে দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও বাংলাদেশের জন্য ওই অতি উষ্ণ তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তা পেলে আমরা সম্মিলিতভাবে ওই পূর্বাভাসও দিতে পারব।’