সাবেক দুই আইজিপিসহ ৮৮ পুলিশের নামে হত্যা মামলা

ঢাকায় ৯৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণ মামলা দায়ের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগে ঢাকায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ৮৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এর বাইরে আরও ১১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে ঢাকার আদালত ও থানায় এসব হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে।

 আসামির তালিকায় রয়েছেন সাবেক তিন আইজিপি, সাবেক দুই ডিএমপি কমিশনার ও র‍্যাবের সাবেক দুজন মহাপরিচালক। এ ছাড়া এসবি ও সিআইডির সাবেক প্রধানকে খুনের মামলার আসামি করা হয়েছে।

 এর বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার ছয়জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় আছেন ১১ জন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি)। এর বাইরে পুলিশ সুপার বা উপকমিশনার পদমর্যাদার ১৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা আছেন আসামির তালিকায়।

 এ ছাড়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বা অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) পদমর্যাদার আরও ১৬ জন কর্মকর্তা আসামির তালিকায় রয়েছেন। সহকারী পুলিশ সুপার বা সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার ৬ জন কর্মকর্তাকেও মামলার আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন থানায় কর্মরত সাবেক ১৩ জন ওসি, ৯ জন পুলিশ পরিদর্শক, ১৩ জন এসআই, ১ জন এএসআই ও ৩ জন পুলিশ কনস্টেবলকে আসামি করা হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতাকে নির্বিচার যারা গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
জেড আই খান পান্না, চেয়ারপারসন, আসক

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর ১৩ আগস্ট থেকে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী-উপদেষ্টা, আইজিপি, সরকারি কর্মকর্তাসহ ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন দুজন সাবেক আইজিপি ও একজন পুলিশ পরিদর্শক।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৭৬০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন এবং ৪ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ৪১৯ জন নিহত হন।

পুলিশ কর্মকর্তাদের খুনের মামলার আসামি হওয়ার বিষয়ে সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী খুনসহ যেকোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে যদি কারও সংশ্লিষ্টতা থাকে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা আসামি হবেন। তদন্তে যদি পুলিশের কোনো কর্মকর্তা কিংবা সদস্যের জড়িত থাকার তথ্য মেলে, সে ক্ষেত্রে তিনি বিচারের মুখোমুখি হবেন। আইন সবার জন্য সমান। পুলিশসহ অপরাধের সঙ্গে যাঁরাই জড়িত থাকুন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনার দায়িত্ব পুলিশের।

সর্বাধিক খুনের মামলার আসামি যেসব পুলিশ কর্মকর্তা

মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় (১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত) হত্যার অভিযোগে সর্বোচ্চসংখ্যক (৩৮টি) মামলার আসামি হয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দাপ্রধান হারুন অর রশীদ। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা-পূর্ব থানাসহ বিভিন্ন থানায় এসব মামলা করেছেন নিহত ব্যক্তিদের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনেরা।

 সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান হারুন অর রশীদের পর সর্বাধিক খুনের মামলার আসামি হয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, লালবাগ, বাড্ডা, নিউমার্কেট, সূত্রাপুর, কাফরুল, উত্তরা-পূর্ব, রামপুরা, যাত্রাবাড়ীসহ ৩৭টি থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন। পরদিন তাঁকে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা মুদিদোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তিনি এখন কারাগারে আছেন। আদালতে আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী দাবি করেছেন, তাঁর মক্কেল নির্দোষ।

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পর সর্বাধিক খুনের (৩৩টি) মামলার আসামি হয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর থানাসহ ১৮টি থানায় এসব হত্যা মামলা হয়েছে।

২৭টি খুনের মামলার আসামি হয়েছেন ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, লালবাগ, শেরেবাংলা, নিউমার্কেট, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন থানায় এসব মামলা করেছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।

এ ছাড়া সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের বিরুদ্ধে সাতটি হত্যা মামলার তথ্য জানা গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় চারটি, লালবাগ, উত্তরা পূর্ব ও নিউমার্কেট থানায় একটি করে হত্যা মামলা হয়েছে। রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় ৩ সেপ্টেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হন। তিনি আদালতে দাবি করেন, তিনি কোনো খুনের ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত নন।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদের বিরুদ্ধে উত্তরা-পশ্চিম থানায় গত ১৯ আগস্ট একটি অপহরণ মামলা হয়েছে। তিনি এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

আরও যেসব পুলিশ কর্মকর্তা খুনের মামলার আসামি

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১১টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি খুনের মামলা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায়। এ ছাড়া পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এর বাইরে র‍্যাবের সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া র‍্যাবের সাবেক প্রধান এম খুরশিদ হোসেনের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে ছয়টি।

এ ছাড়া অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার লুৎফুল কবির ও জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি করে হত্যা মামলা হয়েছে। ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেট থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী, লালবাগ, নিউমার্কেট, আদাবর ও ধানমন্ডি থানায় আটটি মামলা হয়েছে।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাবেক প্রধান মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিউমার্কেট, রামপুরা ও আদাবর থানায় পৃথক তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সিটিটিসির সাবেক যুগ্ম কমিশনার কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশের সাবেক ডিআইজি রিপন সরদারের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দারের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে।

এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদার, রশিদুল হক, সঞ্জিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে একটি করে হত্যা মামলা হয়েছে।

কোন ডিসি কয়টি হত্যা মামলার আসামি

ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় আটটি হত্যা মামলা হয়েছে। ডিএমপির লালবাগ বিভাগের (গোয়েন্দা) সাবেক ডিসি মশিউর রহমান ও আশরাফুল আজিমের বিরুদ্ধে দুটি করে, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিসি তানভির সালেহীন ইমন, ডিসি রাজিব আল মাসুদ, জাহিদ তালুকদার, হায়াতুল ইসলাম, হাফিজ আল ফারুক, এইচ এম আজিমুল হক, মাহাবুব-উজ-জামান ও জাফর হোসেনের বিরুদ্ধে একটি করে হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা জেলার সাবেক এসপি আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়েছে।

কোন এডিসি কয়টি হত্যা মামলার আসামি

ডিএমপির এডিসি নুরুল আমিন, গোবিন্দ চন্দ্র, শাহিন শাহ মাহফুজ, হাফিজ আল আসাদ, জুয়েল রানা, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, সাব্বির রহমান, ফজলে এলাহী, রওশানুল হক সৈকত, শাকিল মোহাম্মদ শামীম ও আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে একটি করে হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত এসপি আবদুল্লাহিল কাফি ও সাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি করে হত্যা মামলা হয়েছে।

হত্যা মামলায় জড়িত প্রত্যেক পুলিশসহ অন্যদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতাকে নির্বিচার যারা গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।