‘চুপচাপ ছেলেটির’ হঠাৎ উত্থানে বিস্মিত পশ্চিমবঙ্গের কন্দর্পপুরের মানুষ

আরাভ খান নামে দুবাইয়ের এই স্বর্ণ ব্যবসায়ী মূলত বাংলাদেশে পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার শহরতলির সঙ্গে কোনো তফাত নেই কলকাতার কেন্দ্র থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণের ক্ষুদ্র জনবসতি কন্দর্পপুরের। কলকাতার দক্ষিণ অংশের দুটি বৃহৎ জনবসতি গড়িয়া ও নরেন্দ্রপুরের মাঝামাঝি এই কন্দর্পপুরেই অন্তত বছরখানেক গা ঢাকা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের রবিউল ইসলাম। ভারতের পাসপোর্টে যাঁর নাম ‘আরভ খান’।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের ‘আরাভ জুয়েলার্স’ উদ্বোধন করান রবিউল। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতেও রাতারাতি ‘তারকা’ হয়ে গেছেন রবিউল ওরফে আরভ।

বিষয়টি ‘অস্বস্তিকর এবং উদ্বেগের’, জানালেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। কন্দর্পপুর দক্ষিণ চব্বিশের প্রশাসনিক এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে।

‘গতকাল এক সাংবাদিকের ফোন এল। তখন পাত্তা দিইনি। আজ এক সিনিয়র অফিসার ফোন করে জানতে চাইলেন বিষয়টা কী, আরভ খান কে? কী বিপদ বলুন তো!, বলেন চব্বিশ পরগণার ওই কর্মকর্তা। জানালেন, এখন পর্যন্ত বিষয়টার কিছুই হদিস করতে পারেননি।

কন্দর্পপুরের উদয় সংঘ ক্লাবের এক সদস্য মিল্টন বিশ্বাস অবশ্য অনেকটাই বলে দিলেন আরভ সম্পর্কে, ‘চুপচাপ ছেলে ছিল। মাঝেমধ্যে ক্লাবে আসত, গল্পগুজব করত। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার দিকে ওদের আগে বাড়ি ছিল বলে জানিয়েছিল। কোভিড শুরু হওয়ার আগে এবং সম্ভবত কোভিড চলাকালীন বছরখানেক এখানে ছিল। একটা বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করত, মাঝেমধ্যে কী সব কাজে টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় যেত বলে আমাদের বলেছিল। সম্ভবত ওখানে কিছু একটা সাপ্লাই করত। এর বেশি কিছু জানি না।’

তবে বিশেষ পয়সাকড়ি আরভের ছিল বলে মনে হয়নি মিল্টনের, ‘পয়সাকড়ি থাকলে ওই রকম রঙচটা ভাঙাচোরা বাড়িতে থাকবে কেন?’

উদয়পুর ক্লাবকে বাঁ হাতে রেখে সামান্য এগোলেই সেই রঙচটা বাড়ি। একেবারেই সাধারণ নিম্নবিত্ত এলাকা, যেখানে প্রায় সব বাড়িরই ইট বেরিয়ে রয়েছে, সিমেন্টের পলেস্তারা পড়েনি। অনেক বাড়িরই রং উঠে গেছে, তারপর নতুন করে আর রং করাননি বাসিন্দারা। এই রকমই এক রঙচটা, জরাজীর্ণ বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়ে বছরখানেক ছিলেন আরভ ওরফে রবিউল।

সেই রবিউল সম্প্রতি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার নম্বর ৬৫১০। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিকও তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। যেখানে মাঝেমধ্যে মায়াবী হরিণ জবাই দিয়ে বাংলাদেশিদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। বাগানে চাষ করছেন বাংলাদেশি সবজি। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন উপলক্ষে ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বাজপাখির আদলে লোগো, যা তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস। এটা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

রবিউল ওরফে আরভ কন্দর্পপুরের যে বাড়িতে ছিলেন, সেই বাড়ির দরজায় লেখা ৭৮৬। বাড়ির মালিক রেহানা বিবি খান। তিনি বাসায় ছিলেন না। তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, বছরখানেক আগে তাঁর বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়েছিলেন ‘আরভ’। দুই হাজার টাকা ভাড়া দিতেন। ‘আমাদের থেকে আধার কার্ড নিয়েছিল এবং তা দিয়ে কী একটা কাগজ বানিয়েছে শুনেছিলাম। মোটামুটিভাবে বছর পাঁচেক আগে এসেছিল বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে। তবে তারপর কোথায় গেছে জানি না’, বলেছেন রেহানা।

রেহানার স্বামী মুদিখানার মালিক জাকির খান মারা গেছেন। ‘আরভের’ কথা কার্যত ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। ‘তবে হ্যাঁ, আমাদের বাবা-মা বলেই ডাকত’, বলেছেন রেহানা। আর ‘বাবা-মা’ ডাকের জোরে রবিউল ওরফে ‘আরভ’ তাঁর পাসপোর্টে জাকিরকে বাবা ও রেহানাকে মা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টা কীভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়ে একেবারেই নিশ্চিত নন রেহানা। মাত্র বছরখানেক তাঁর ভাড়াটে হিসেবে থেকে তাঁকে কীভাবে মা বানিয়ে ফেললেন ‘আরভ’, সে এক বিরাট বিস্ময় রেহানার।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাসপোর্টের পেছনের পাতায় লেখা ‘ইমিগ্রেশন চেক রিকোয়ার্ড’। পাসপোর্ট বানানোর সময় যদি কোনো ভারতীয় বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার আবেদন করেন, তখনই পাসপোর্টে এটি লেখা হয়। অর্থাৎ ২০২০ সালে পাসপোর্ট বানানোর সময়ই দুবাই যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন আরভ এবং কোনো এক ফাঁকে চলেও যান।

হয়তো সারা জীবনই আর পাঁচটা বাঙালির মতোই আরভ খানকে নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকা থেকে উঠে আসা এক কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক ছোটখাটো ‘সাপ্লায়ার’ হিসেবেই মনে রাখতেন মিল্টন, রেহানাসহ কন্দর্পপুরের বাসিন্দারা। যদি না হঠাৎই তারকাদের দুবাইয়ে হাজির করে জমকালোভাবে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ উদ্বোধন না করাতেন।

‘কত অদ্ভুত কাণ্ডই যে পৃথিবীতে...’, রবিউল ওরফে আরভ খানের উত্থানের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন কন্দর্পপুরের উদয় সংঘ ক্লাবের সেই মিল্টন বিশ্বাস।