গ্যাসের সরবরাহ এখনই বাড়ছে না 

আগামী এপ্রিলের আগে আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আসার সম্ভাবনা কম। 

শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। তাই কারখানা চালাতে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস নিচ্ছেন কেউ কেউ। গতকাল ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

সাত মাস ধরে আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ রেখেছে সরকার। নতুন করে এলএনজি কেনার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। এর মধ্যেই শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন থেকে উদ্যোগ নিলেও সবকিছু চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে এলএনজি দেশে আনতে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

অন্যদিকে দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকেও উৎপাদন বাড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, গ্যাসের নতুন দাম থেকে আসা বাড়তি টাকা পেট্রোবাংলার হিসাবে জমা হবে আগামী এপ্রিল-মে মাসে। এর আগে সরকার টাকা দিলেও এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হবে ঋণপত্র খোলা ও ডলারের সংস্থান করা। 

পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এলএনজি সরবরাহকারীরা অর্থ পরিশোধের নিশ্চয়তা ছাড়া এলসি (ঋণপত্র) নিতে রাজি হয় না। দেশের কোনো ব্যাংকের পক্ষে এটি নিশ্চিত করা এখন কঠিন। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে এখানে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।

পেট্রোবাংলার নির্দেশে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করার কাজটি করে আরপিজিসিএল। এই সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাননি তাঁরা। নির্দেশনা পেলে তাঁরা এলএনজি কিনতে দরপত্র আহ্বান করবেন। দরপত্র অনুযায়ী কার্যাদেশের কাজ দ্রুত শেষ করলেও আগামী এপ্রিলের আগে দেশে এলএনজিবাহী জাহাজ (কার্গো) আসার সম্ভাবনা কম। আর পেট্রোবাংলা বলছে, খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি জ্বালানি বিভাগ। 

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার গ্যাস এবং ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল থেকে এলএনজি আনছে আরপিজিসিএল। ২০১৮ সালের এপ্রিলে দেশে প্রথম এলএনজি কার্গো আসে কাতার থেকে। এরপর ২০১৯ সালে ৬৩টি ও ২০২০ সালে ৬৬টি কার্গো আসে দুই দেশ মিলে। ২০২১ সালেও আসে ৬৫টি। ওই সময় খোলাবাজার থেকে আনা হয়েছে ১৬টি কার্গো। আর গত বছর ওই দুটি দেশ থেকে এসেছে ৫৬টি কার্গো। সরকার একাধিকবার আবেদন করলেও এলএনজির সরবরাহ বাড়াতে রাজি হয়নি কাতার ও ওমান। আর খোলাবাজার থেকে গত বছর ৩৪টি কার্গো আনার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আনা গেছে মাত্র ১২টি। 

তবে এলএনজি আমদানি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার। খোলাবাজার থেকে কেনা এলএনজি মার্চে আসা শুরু হবে বলে আশাবাদী তিনি।

লাগবে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি

দেশে আমদানি করা এলএনজি থেকে দিনে ৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা আছে। তবে পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করতে দিনে অন্তত ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হবে। এর জন্য এক বছরে এলএনজি বহনকারী ১০৩টি কার্গো আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এ বছর পাওয়া যাবে ৫৬টি। বাকি ৪৭টি কিনতে হবে খোলাবাজার থেকে। বর্তমানে খোলাবাজারে এলএনজির দাম প্রতি ইউনিট ২২ ডলার (গত বছর সর্বোচ্চ ৬০ ডলার পর্যন্ত দাম উঠেছিল)। এ দামে কিনতে হলে ৪৭টি কার্গোর জন্য লাগবে প্রায় ৩৩০ কোটি ডলার।

আরপিজিসিএল সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকায় কাতার থেকে এক ইউনিট এলএনজি ১১ দশমিক ৫৫ ডলার এবং ওমান থেকে ১১ দশমিক ৩৫ ডলারে আমদানি করা হচ্ছে এখন। এ বছর গড়ে ১১ ডলারে আমদানি করা গেলেও দুটি দেশকে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কমার প্রবণতা আছে। এটি অব্যাহত থাকলে এলএনজি আমদানির খরচ কমতে পারে। এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে দুই টার্মিনালের (দেশে এলএনজি টার্মিনাল আছে মাত্র দুটি, কক্সবাজারে) পেছনে বছরে ব্যয় হবে আরও অন্তত ১৮ কোটি ডলার। 

বিকল্প উৎস খুঁজছে সরকার

দেশে এখন মহেশখালীর গভীর সমুদ্রবন্দরে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে। বিদেশ থেকে এলএনজি আনার পর এসব টার্মিনালে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তা প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তর করা হয়। এরপর সেখান থেকে গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। এলএনজির একটি টার্মিনাল চালাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও অন্যটি দেশীয় কোম্পানি সামিট। দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা এলাকার গভীর সমুদ্রে আরও একটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ি এলাকায় স্থলভাগে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় সরকার। 

খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা লাভজনক। তাই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আরও ৩০ থেকে ৩৫ কোটি ঘনফুট আমদানি বাড়াতে চায় সরকার। চুক্তি করতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত বছর আলোচনাও শুরু করে সরকার। তাদের কারও সঙ্গেই এখন পর্যন্ত চুক্তি করা যায়নি। এর মধ্যে আছে বেসরকারি কোম্পানি সামিট ও আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি। কাতারের সঙ্গেও আরেকটি চুক্তি করার পরিকল্পনা আছে। এর বাইরে ব্রুনেই থেকেও এলএনজি আনতে আলোচনা শুরু করেছে সরকার। 

ভারত থেকে পাইপলাইনে করে সরাসরি এলএনজি আনার কাজেও তেমন গতি আসেনি। পশ্চিমবঙ্গের একটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে সাতক্ষীরার ভোমরা হয়ে এলএনজি রপ্তানির বিষয়টি যাচাই করে দেখছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (আইওসিএল)। সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করে জাতীয় গ্রিডে এ গ্যাস যুক্ত হবে।

পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমদানিনির্ভরতা

পেট্রোবাংলার হিসাবে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতি ইউনিট গ্যাসের উৎপাদন খরচ ২ টাকা ১৫ পয়সা। ৮০ শতাংশের বেশি গ্যাস আসে দেশীয় উৎস থেকে। কিন্তু চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে খরচ বাড়ছে পেট্রোবাংলার। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রতি ইউনিটে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২০ টাকার কিছু বেশি। এ বছরের (২০২২-২৩) প্রথম ছয় মাসে গড়ে খরচ হয়েছে ১৯ টাকা। এতে সরকারের ভর্তুকি বাড়ছিল। ৬ মাসেই ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দাবি করেছে পেট্রোবাংলা। 

ভর্তুকির চাপ কমাতে ইতিমধ্যে গ্যাসের রেকর্ড দাম বাড়িয়েছে সরকার। এতে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের গড় দাম ১১ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২১ টাকা ৬৭ পয়সা করা হয়েছে। আর্থিক চাপ সামলাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একের পর এক দাম বাড়াচ্ছে সরকার। গত জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। এর ৭ মাস পর গত বুধবার আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো গড়ে ৮২ শতাংশ। শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতের গ্রাহকদের এ দাম দিতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার না করে আমদানিনির্ভরতার দিকে ঝোঁকার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এক যুগেও সমুদ্রে সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। এখন দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। তিন বছরে ৪৬টি কূপ খনন করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তবে দ্রুত গ্যাস উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র থেকেও উৎপাদন কমছে। দেশে এখন দিনে উৎপাদন সক্ষমতা আছে ২৭৬ কোটি ঘনফুট; আর তোলা হচ্ছে ২২৩ কোটি ঘনফুট। 

দেশে এখন দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দিনে ৩১০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি নিশ্চিত করা যায়। আর এখন গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। এতে গ্যাস-সংকটে বন্ধ রাখতে হচ্ছে শিল্পকারখানা। উৎপাদন না করেই কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিচ্ছে অধিকাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিনে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে সিএনজি স্টেশন। গৃহস্থালি রান্নার চুলা জ্বালাতেও ভোগান্তিতে গ্রাহক। এ সংকট থেকে বাঁচতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশায় বাড়তি দাম দিতে রাজি হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন গ্যাস পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পেট্রোবাংলা হয়তো বাড়তি আয় করবে। তবে এলএনজি কেনার জন্য ডলার লাগবে। দেশে ডলারের সংকট আছে। তাই ব্যবসায়ীদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম।