সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ: গাফিলতি ছিল তদারকি সংস্থার

জেলা প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা। নিয়ন্ত্রণের ভালভ অকেজো থাকায় চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে সাত থেকে আট গুণ বেশি হয়ে বিস্ফোরণ।

বিস্ফোরণে জ্বলছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুলের অক্সিজেন প্ল্যান্ট

চট্টগ্রামে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডে বিস্ফোরণের ঘটনায় তদারকি সংস্থার গাফিলতি ছিল বলে উল্লেখ করেছে জেলা প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, প্ল্যান্টের এয়ার সেপারেশন কলামে সেফটি ভালভ (চাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) অকেজো থাকার বিষয়টি। ভালভ অকেজো থাকায় দাহ্য হাইড্রোকার্বনের মতো গ্যাস এয়ার সেপারেশন কলামে জমা হতে থাকে, একপর্যায়ে এই চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে সাত থেকে আট গুণ বেশি হয়। পরে কোনো একটি স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গের স্পর্শ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। কারখানায় দক্ষ জনবল না থাকায় বিষয়টি আগে ধরা পড়েনি।

বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আট পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছে। জেলা প্রশাসক জানান, তদন্ত প্রতিবেদনটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হবে। সেখান থেকে নির্দেশনা আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

৪ মার্চ সীমা অক্সিজেন লিমিটেডে বিস্ফোরণের ঘটনার পর এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই ঘটনায় সাতজন মারা যান, আহত হন ২৫ জন। গতকাল পর্যন্ত ১০ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি এয়ার সেপারেশন কলামটি। এ কারণে বিস্ফোরণের পর কলামটির বড় বড় টুকরা আধা কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত গিয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কারখানাটির বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র থাকলেও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, ‘তদন্তে কারণ উদ্‌ঘাটন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য করণীয় সম্পর্কিত ৯টি সুপারিশ তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে। তবে এটা বলতে পারি, সীমা প্ল্যান্টের কিছু কমপ্লায়েন্সের (কর্মসহায়ক পরিবেশ) ঘাটতি ছিল।’

সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির বাকিরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (তদন্ত) সুদীপ্ত সরকার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আবদুল হালিম, সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহদাত হোসেন, সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তরের কর্মকর্তা শুভংকর দত্ত, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের সহকারী পরিদর্শক এস এম শাখাওয়াত হোসেন। কারিগরি–বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মামুনুর রশিদ এবং ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুমন বড়ুয়া।

তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই বিস্ফোরণ কোনো নাশকতার ঘটনা নয়। এ ছাড়া বাইরে পড়ে থাকা সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও এ ঘটনা ঘটেনি। কারণ, সিলিন্ডারগুলো অক্ষত রয়েছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতিও এমন হয় না বলে তদন্ত কমিটি মনে করে। দক্ষ জনবলের অভাব টেকনিক্যাল (কারিগরি) গাফিলতির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মাত্র দুজন ডিপ্লোমাধারীকে দিয়ে কারখানার কার্যক্রম চলছিল।

তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির সরঞ্জাম–সম্পর্কিত কোনো তালিকা রাখেনি, যার কারণে কী কী যন্ত্রপাতি কোন মানের ছিল তা জানতে কমিটির গলদঘর্ম হয়েছে। প্ল্যান্ট–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে যা তথ্য পাওয়া গেছে, তা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে কমিটি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত অক্সিজেন প্ল্যান্টের কলামে চাপ ৪ থেকে ৮ বিএআর (ব্যারোমেট্রিক প্রেশার-গ্যাসের চাপের একক) পর্যন্ত সহনীয়। কিন্তু সীমা প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের সময় তা ৭ থেকে ৮ গুণ বেড়ে অন্তত ৬০ বিএআর পর্যন্ত হয়। এ জন্য অনেক দূরে কলামের টুকরা ছড়িয়ে পড়ে।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলেন, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনা প্রযুক্তির এই কারখানার চার বছর ধরে কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। নিয়মিত এয়ার ফিল্টার, ভাল্‌ভ, ছিদ্র বা লিকেজ ও অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থার তদারকি হয়নি। বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসেরও নিয়মিত তদারকি ছিল না।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, তদারকিতে ফায়ার সার্ভিসের চেয়ে অন্য সংস্থাগুলোর দায়িত্ব বেশি। অন্যদিকে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের সহকারী পরিদর্শক এস এম শাখাওয়াত হোসেন জনবলের সংকটের কারণে নিয়মিত তদারকি হয়ে ওঠে না বলে উল্লেখ করেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, অক্সিজেন প্ল্যান্টে সাধারণত ‘পারলাইট’ নামের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এতে এয়ার সেপারেশন কলামের মাধ্যমে অক্সিজেন আলাদা করে ও নাইট্রোজেন ছেড়ে দেয়। এ সময় কলামের চাপ কমা এবং বাড়ার কাজটি করা হয় ভাল্‌ভের মাধ্যমে। ভাল্‌ভ কাজ না করলে হাইড্রো কার্বন জমা হতে থাকে, যা অক্সিজেনের সংস্পর্শে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

৯ দফা সুপারিশ

কমিটির ৯ দফা সুপারিশের মধ্যে অন্যতম—প্রতিবছর প্ল্যান্টের চাপ নিয়ন্ত্রণের ভাল্‌ভ ও এয়ার ফিল্টার পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। চাপের তারতম্যের সময় অ্যালার্ম দিচ্ছে কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখার পাশাপাশি প্ল্যান্টে কোনো ছিদ্র বা লিকেজ রয়েছে কি না, তা তদারক করা। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ছাড়পত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের কর্মসহায়ক পরিবেশ সংবলিত সনদ থাকা, বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে তদরকি কমিটি গঠন, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় আগাম প্রস্তুতি থাকা ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মামুনুর রশিদ বলেন, যেকোনো অক্সিজেন প্ল্যান্টের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। এ জন্য দরকার দক্ষ জনবলও। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করে তদারকি আরও বাড়াতে হবে।