কর
কর

সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর আদায় কেন কার্যকর হচ্ছে না পৌরসভায়

প্রাথমিকভাবে দেশের ৩৪টি জেলা সদর পৌরসভায় ১ জুলাই থেকে ‘ডিজিটাল ট্যাক্সেশন সিস্টেম’ চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে পৌরসভাগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর আদায়ের এই কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

দেশের পৌরসভাগুলোর আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা, বিশেষ করে কর আদায় কম হওয়া নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই অটোমেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর নির্ধারণ ও আদায়ে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব বিষয়ে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। সফটওয়্যারে অনেক বিষয় রয়েছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া এটি ব্যবহার করাও কঠিন।
আরিফুল ইসলাম, কুষ্টিয়া পৌরসভার কর নির্ধারক

পৌরসভার কর আদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর আদায়ের এ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তবে প্রস্তুতির ঘাটতি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সহায়তার অভাব এবং সফটওয়্যারের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা না থাকায় তাঁরা হতাশা প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, ইতিবাচক এ উদ্যোগ চালু করার আগে আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। সুফল পেতে সফটওয়্যারের ব্যবহার নিয়েও দরকার নিবিড় প্রশিক্ষণ।

১ জুলাই যেসব পৌরসভায় ডিজিটাল ট্যাক্সেশন চালু করার কথা ছিল, এর মধ্যে সাতটি পৌরসভায় যোগাযোগ করা হয়। রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নাটোর, নেত্রকোনা ও দিনাজপুর পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর আদায় কার্যক্রম শুরু করেননি। অনেকে বুঝতেই পারছেন না এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে কীভাবে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া কর আদায়-সংক্রান্ত অনেক তথ্য সফটওয়্যারে হালনাগাদ করতে হবে। এ কাজ করতেও পৌরসভাগুলোর কয়েক মাস চলে যাবে।

দেশের ৩৩১টি পৌরসভার অধিকাংশের অবস্থাই রুগ্‌ণ। রাজস্ব আয় কম। অনেক পৌরসভায় কর্মীদের বেতন-ভাতা বকেয়া। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পৌর মেয়রদের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও রয়েছে। কর নির্ধারণ ও আদায়ও হয় খেয়ালখুশি মতো। এমন পরিস্থিতিতে পৌরসভার কাজে স্বচ্ছতা আনতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

কুষ্টিয়া পৌরসভার কর নির্ধারক আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর নির্ধারণ ও আদায়ে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব বিষয়ে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। সফটওয়্যারে অনেক বিষয় রয়েছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া এটি ব্যবহার করাও কঠিন।’

পর্যাপ্ত কারিগরি সহায়তা ছাড়া পৌরসভাগুলোর পক্ষে সফটওয়্যার ব্যবহার করে কর আদায় করা কঠিন বলে জানান নাটোর পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সচল করতে হলে সফটওয়্যার-সংশ্লিষ্ট কাউকে পৌরসভায় উপস্থিত থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ধারণা দিতে হবে। পৌরসভায় ১৮ হাজারের বেশি হোল্ডিং। সেগুলোর তথ্য হালনাগাদ করতে হলেও কয়েক মাস লাগবে।’

দেশের ৩৩১টি পৌরসভার অধিকাংশের অবস্থাই রুগ্‌ণ। রাজস্ব আয় কম। অনেক পৌরসভায় কর্মীদের বেতন-ভাতা বকেয়া। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পৌর মেয়রদের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও রয়েছে। কর নির্ধারণ ও আদায়ও হয় খেয়ালখুশি মতো। এমন পরিস্থিতিতে পৌরসভার কাজে স্বচ্ছতা আনতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর অংশ হিসেবে কর আদায়ের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ওই সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অনেক সময় স্থানীয় পর্যায়ে কর বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানো হয়। সফটওয়্যার চালুর বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে শুধু আদেশ দেওয়া হলো, কারা দেখভাল করবে, কীভাবে তথ্য যুক্ত করা হবে, সেগুলো নিশ্চিত করা হলো না। এতে ইতিবাচক উদ্যোগের দুর্বল দিক সামনে আসছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে কর আদায় ডিজিটাল হলে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
মহসিন আলী, গভর্নেন্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী

পৌরসভাগুলোয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর আদায় কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে গত ৪ জুন পৌর মেয়রদের চিঠি পাঠান স্থানীয় সরকার বিভাগের পৌর-২ শাখার উপসচিব সালমা সিদ্দিকা। তাতে বলা হয়, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ৩৪টি জেলা সদর পৌরসভায় আবশ্যিকভাবে ১ জুলাই থেকে ছয়টি বিষয়ে অটোমেশন কার্যক্রম ওয়েববেজড সফটওয়্যার অনুযায়ী শুরু করতে হবে।

এই ছয় বিষয় হলো হোল্ডিং ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট-অ্যাসেসমেন্ট (গৃহকর ব্যবস্থাপনা-নির্ধারণ), হোল্ডিং ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট-বিলিং অ্যান্ড কালেকশন (গৃহকর ব্যবস্থাপনা-বিল করা ও আদায়), মিউনিসিপ্যাল অ্যাকাউন্টিং, ট্রেড লাইসেন্স ও অযান্ত্রিক যানবাহন লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা, মুভেবল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (অস্থাবর সম্পদ ব্যবস্থাপনা) ও ওয়াটার বিলিং অ্যান্ড কালেকশন (পানির বিল ও আদায়)।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব সালমা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সফটওয়্যার চালু হলে কর আদায় নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। প্রথম ধাপে ৩৪টি পৌরসভায় চালু করা হচ্ছে। অটোমেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর আদায়ে কী কী সমস্যা হচ্ছে, সেসব তথ্য নেওয়া হচ্ছে।’ এসব পৌরসভায় ব্যবস্থাটি পুরোপুরি চালু করতে কিছুদিন সময় লাগবে এবং দেশের সব পৌরসভার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এখনো শেষ হয়নি বলে জানান তিনি।

পৌরসভার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হোল্ডিং ট্যাক্সের সফটওয়্যারের বিষয়ে পৌরসভার কর নির্ধারক ও সহকারী কর নির্ধারকদের বিভাগীয় পর্যায়ে দুই দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সফটওয়্যার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। সেটাও বছর দুই আগে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে কর নির্ধারণ ও আদায়ের সঙ্গে পৌরসভার বেশ কয়েকটি বিভাগ জড়িত। সেসব বিভাগের কারও প্রশিক্ষণ হয়নি।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা গভর্নেন্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী মহসিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক সময় স্থানীয় পর্যায়ে কর বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানো হয়। সফটওয়্যার চালুর বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে শুধু আদেশ দেওয়া হলো, কারা দেখভাল করবে, কীভাবে তথ্য যুক্ত করা হবে, সেগুলো নিশ্চিত করা হলো না। এতে ইতিবাচক উদ্যোগের দুর্বল দিক সামনে আসছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে কর আদায় ডিজিটাল হলে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।’