যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাংস্টার আল কাপোনের পুরো নাম ছিল আলফনসো গ্যাব্রিয়েল কাপোন (১৮৯৯-১৯৪৭)। কারাগারে যাওয়ার আগে নিউইয়র্কের অপরাধজগতে সাত বছর রাজত্ব করেছেন তিনি। কাপোনের নাম অন্য অপরাধী দলের বুকে কাঁপন ধরাত।
যা-ই হোক, কাপোনের পরিচিতি দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এই লেখা বাংলাদেশে সম্প্রতি জারি হওয়ার আয়কর আইনের একটি বিধান নিয়ে, যা বেসরকারি চাকরিজীবীদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে।
নতুন বিধানে যাঁরা বেসরকারি চাকরিজীবী, তাঁদের ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) ও আনুতোষিক (গ্র্যাচ্যুইটি) তহবিলের আয়ের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ আয়কর আরোপ করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অবশ্য এই আয়কর নেই।
আয়কর নিয়ে আল কাপোনের একটি উক্তি বেশ মজার। তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁরা অবৈধ অর্থ থেকে বৈধ কর সংগ্রহ করতে পারে না।’ বাংলাদেশ সরকারও বিপুল কালো অর্থনীতি থেকে কর আদায় করতে পারছে না। ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর নিতে পারছে না।
প্রাচীন রোমে মূত্রের ওপর কর বসিয়েছিলেন রোমান সম্রাট নিরো (৩৭-৬৮ খ্রিষ্টাব্দ)। তখন মানুষের মূত্র চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হতো। ব্যবসায়ীরা মূত্র সংগ্রহ করতেন, কেনাবেচা করতেন।
করজালের বাইরে বিপুল মানুষ। সহজ শিকার বেসরকারি কোম্পানি ও বেসরকারি চাকরিজীবী। তাঁদের কাছ থেকে কর আদায়ে শুধু নিয়ম করলেই হয়। কোম্পানিই হিসাব করে কর পৌঁছায় সরকারের কোষাগারে। বসে বসে টাকা আয়ের এই সহজ পথ কে ছাড়ে, সেটা ন্যায্য হোক, অন্যায্য হোক।
প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ—কর আদায়ে মরিয়া হয়ে রাজা-বাদশাহরা বহু বিচিত্র পথে হেঁটেছেন। আসুন, কয়েকটি করের কথা জেনে তারপর ভবিষ্য তহবিলের করের দিকে যাই।
ক. মূত্রকর
প্রাচীন রোমে মূত্রের ওপর কর বসিয়েছিলেন রোমান সম্রাট নিরো (৩৭-৬৮ খ্রিষ্টাব্দ)। তখন মানুষের মূত্র চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হতো। ব্যবসায়ীরা মূত্র সংগ্রহ করতেন, কেনাবেচা করতেন। তা নজরে পড়ে নিরোর। বসিয়ে দেন মূত্রকর। রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ানের সময়ও ছিল মূত্রকর।
খ. জানালাকর
ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ১৬৯৬ সালে জানালাকর আরোপ করেন। বিষয়টি ছিল এমন, কর হিসাবের ক্ষেত্রে ভবনের জানালার সংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হবে। ধনীদের ভবনে যেহেতু বেশি জানালা, তারা বেশি কর দেবেন। ১৫৫ বছর বহাল থাকার পর এই কর বাতিল হয়।
বলা বাহুল্য, কৌশলটি খুব একটা কাজ করেনি। কারণ, কর আরোপের পর ধনীরা জানালা ইট দিয়ে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন। এতে মানুষের ঘরে আলো–বাতাস কমে যায়। জাতির স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। জানালাকর বাতিল করা ছাড়া আর উপায় ছিল না।
গ. জ্ঞানকর
ব্রিটেনে ১৮১৫ সালে সংবাদপত্র কেনার সময় কর আরোপ শুরু হয়। এটারও লক্ষ্য ছিল ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়। ধনীদের বাড়িতেই তখন সংবাদপত্র বেশি যেত। ফলে আশা করা হয়েছিল, সংবাদপত্র কেনার সময় কর আরোপ হলে ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা পাওয়া যাবে।
ফল হয় উল্টো। ধনীদের অনেকেই সংবাদপত্র কেনা বন্ধ করে দেন। ফলে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা কমে যায়। আর এটা সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সরশিপ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৮৫৫ সালে জ্ঞানকর বাতিল হয়।
ভারতের ত্রিভাঙ্কুরে নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীরা বুক ঢেকে রাখতে চাইলে কর দিতে হতো, নাম ছিল স্তনকর। করের অর্থের বড় অংশ জমা হতো অত্যন্ত ধনী পদ্মনাভ মন্দিরে। স্তনকরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এক নারী, নাম নাঙ্গেলি।
ঘ. দাড়িকর
১৬৯৮ সালে রাশিয়ার সম্রাট প্রথম পিটার দাড়ির ওপর কর বসান। যাঁরা দাড়ি রাখতে চাইতেন, তাঁদের কর দিতে হতো। পিটার চাইতেন, রুশরা পশ্চিমাদের মতো ফ্যাশনে অভ্যস্ত হোক। সে জন্য ফেলে দিতে হবে দাড়ি। জোর করে লাখ লাখ মানুষের দাড়ি তো ফেলে দেওয়া যায় না, তাই কর। ইংল্যান্ডে রাজা তৃতীয় হেনরির (১৪৯১-১৫৪৭) আমলে এই কর ছিল।
ঙ. তাসকর
ষোড়শ শতকের শুরু থেকে এই কর ছিল ব্রিটেনে। ১৭১০ সালে ইংলিশ সরকার তাস খেলার ওপর করের হার বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য তাস খেলার সময় নানা রকম চুরিতে অভ্যস্ত খেলোয়াড়েরা কর ঠিকঠাকমতো দেবেন, সেটা আশা করা যায়নি।
পৃথিবীতে কর এসেছে বহু বছর আগে। কর আরোপের প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন মিসরে, খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে। এরপর পৃথিবীতে নানারূপে কর এসেছে।
যার যা ধর্ম বইয়ে প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন জিজিয়া করের কথা। তিনি লিখেছেন, জিজিয়া শব্দগত অর্থ সামরিক কর্তব্য থেকে অব্যাহতিজনিত কর। খিলাফতের আমলে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যে স্বীকৃত অমুসলিম একেশ্বরবাদীদের (জিম্মি) ওপর এই কর ধার্য করা হতো। মূলত আরবের কতিপয় খ্রিষ্টান ও ইহুদি গোত্রকে এই কর দিতে হতো।
যেহেতু ইসলাম বাদে অন্য ধর্মের কাউকে সেনাবাহিনীতে যেতে হতো না, সেহেতু রাষ্ট্রের সুরক্ষা বাবদ তাঁরা কর দিতেন।
প্রাথমিক যুগের খলিফাদের আমলে বিজিত এলাকাগুলোর সব জিম্মি সম্প্রদায়কে এই শর্তে জিজিয়া প্রদান করতে হতো যে তার বিনিময়ে রাষ্ট্র তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেবে। অষ্টম শতকের শেষভাগে শাসনতান্ত্রিক ও আর্থিক ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জিজিয়ার সংজ্ঞা ও প্রকৃতিতেও কিছু পরিবর্তন ঘটে। ভারতে সম্রাট আকবর এই কর রহিত করেন, কিন্তু আওরঙ্গজেবের আমলে তা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
কোথাও কোথাও মুসলমানদের জিজিয়া কর দিতে হতো। যেমন ১১৫৪ সালের দিকে সিসিলি রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া করা হতো। বিনিময়ে তারা পেত নিরাপত্তা।
মধ্যযুগে ইহুদিদের বিভিন্ন রাজ্যে কর দিতে হতো। এর একটির নাম ছিল লিইবজল। রোমান সম্রাটেরা ইহুদিদের কাছ থেকে এই কর নিতেন।
হাঙ্গেরিতে ইহুদিদের কাছ থেকে ১৭৫০ থেকে ১৮০০ সালের কাছাকাছি পর্যন্ত ‘টলারেন্স ট্যাক্স’ আদায় করা হতো। সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার আমলে বলা হয়েছিল, তাঁরা যেহেতু ইউরোপে ইহুদিদের সহ্য করছে, সেহেতু কর দিতে হবে।
ভারতের ত্রিভাঙ্কুরে নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীরা বুক ঢেকে রাখতে চাইলে কর দিতে হতো, নাম ছিল স্তনকর। করের অর্থের বড় অংশ জমা হতো অত্যন্ত ধনী পদ্মনাভ মন্দিরে। স্তনকরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এক নারী, নাম নাঙ্গেলি। নিজের স্তন দুটি কেটে কর আদায়কারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু যে আগুন তিনি জ্বেলে গিয়েছিলেন, তাতে মুক্তি পেয়েছিলেন ত্রিভাঙ্কুরে নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীরা।
বাংলাদেশে নতুন আয়কর আইন জাতীয় সংসদে পাস হয় গত জুনে। আইনের বিভিন্ন দিক একটু একটু করে সামনে আসছে। যেমন গত সপ্তাহে সামনে এল ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিকের তহবিলের আয়ের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ করের বিষয়টি।
সাধারণত ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিক তহবিলের অর্থ স্থায়ী আমানতে (এফডিআর) কিংবা সঞ্চয়পত্র ক্রয়সহ বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে খাতভেদে এ বিনিয়োগের মুনাফার ওপর উৎসে কর হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কর কেটে রাখা হতো। এখন থেকে কাটা হবে সাড়ে ২৭ শতাংশ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শেষে নিজের জমানো ও সমপরিমাণ অফিসের দেওয়া টাকা এবং জমা টাকার ওপর সুদ বাবদ বেসরকারি চাকরিজীবীরা কিছু টাকা পান। সব প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্য তহবিলও নেই। আবার শ্রম আইন অনুযায়ী আনুতোষিক দেয় না অনেক প্রতিষ্ঠান। সেটা নিশ্চিতে সরকারের নজর নেই। বরং কর আদায়ে এখন বেছে নেওয়া হয়েছে ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিকের তহবিলকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিক তহবিলের আয়ের ওপর কর নেই। সরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিলে সরকার ১৩ শতাংশ সুদ দেয়। এটা আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ। সঞ্চয়পত্রেও এত বেশি হারে সুদ নেই।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে। দুই বছর আগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করেছে উৎসব করে। সেই বাংলাদেশে এমন একটি কর আরোপ হলো, যেটি প্রযোজ্য হবে শুধু বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে। সংবিধানের ১৯(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
শুধু বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের ওপর আরোপ করা কর নিয়ে কোনো কথা নেই। অর্থনীতিবিদেরা নিশ্চুপ, নাগরিক সমাজ নিশ্চুপ, বেসরকারি চাকরিজীবীরাও নিশ্চুপ। রাজনীতিবিদেরা তো চুপই। কেউ প্রশ্ন করছে না, ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিকের মতো সামাজিক সুরক্ষার আয়ে কর কেন, শুধু বেসরকারি খাতের ওপর কর কেন?
মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে নাইটরা যুদ্ধে যাওয়া এড়াতে পারতেন বাড়তি কর দিয়ে। চালুর পর খুব শিগগির তা কাপুরুষতার কর নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশে এই কর আরোপ করলে সরকারের কোষাগার উপচে পড়বে বলেই আশা করা যায়।