গত সাড়ে পাঁচ বছরে পাঁচটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে গ্যাসলাইনের ত্রুটির কারণে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৪ জন।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় ১৯৮৭ সালের দিকে। তখন যে পাইপলাইন বসানো হয়েছিল, তা দিয়ে এখনো চলছে গ্যাস সরবরাহের কাজ। ৩৬ বছরের পুরোনো এই লাইনে গ্যাস সরবরাহে বাড়ছে ঝুঁকি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে পাঁচটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে গ্যাসলাইনের ত্রুটির কারণে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৪ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসলাইনের পাইপ ২৫ থেকে ৩০ বছর বেশি হলে ঝুঁকি তৈরি করে। এখন চট্টগ্রামের গ্যাসলাইনের বয়স ৩৬ বছর হয়ে গেছে। এখন আরেকটি দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা না করে গ্যাসলাইন কী অবস্থায় আছে, তার তদারক করা জরুরি।
জনবলসংকটের কারণে সব লাইন নিয়মিত তদারক করা সম্ভব হয় না। তবে কেজিডিসিএলের ১৬টি পরিদর্শন দল রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে রাইজার ও লাইন পরিদর্শন করেছে।মো. রফিকুল ইসলাম, কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
শুরুর দিকে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড নামে কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু জায়গায় গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এর মধ্যে ২০১০ সালে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস পুনর্বিন্যাস করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল) রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে কোম্পানির আওতাধীন এলাকা হলো চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের উপজেলা। প্রায় ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। মোট গ্রাহক-সংযোগ রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৭০৩টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ আছে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭২টি, বাকিগুলো শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে।
পুরোনো লাইনে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থাকে খোদ কেজিডিসিএলই সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, শহরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য নেটওয়ার্ক প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে লাইন ছিদ্র হচ্ছে বেশি।
সংস্থাটির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯১ কিলোমিটার বিতরণ লাইনে ছিদ্রের উৎস পাওয়া যায় ৫ হাজার ৫৯৫টি। এসব উৎস চিহ্নিত করা হয় ভূতাত্ত্বিক ম্যাপের মাধ্যমে। এ ছাড়া জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও রক্ষণাবেক্ষণ দলের মাধ্যমে ওই অর্থবছরে মাত্র ৮০৮টি ছিদ্র মেরামত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি ছিদ্রের কারণে ওই অর্থবছরে ১৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পুরোনো লাইনে গ্যাস সরবরাহকে সমস্যা হিসেবে দেখলেও নতুন করে ছিদ্র হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত তদারক করা হয় না। অথচ গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি, ২০১৪–এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, আবাসিক খাতে মিটার ছাড়া গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দুই বছরে একবার আর মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বাসায় বছরে একবার পরিদর্শনে যেতে হবে। লাইনের পাশাপাশি নিয়মিত রাইজার পরীক্ষাতেও গরজ কম সংস্থাটির।
কেজিডিসিএল সূত্র জানায়, সংস্থাটির প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার রাইজারের মধ্যে শহর এলাকায় আছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। বাকিগুলো গ্রাম এলাকায়। ২০১৯ সালে আট মাসে শহর এলাকায় পরীক্ষায় প্রায় ৯ হাজার রাইজারে ত্রুটি ধরা পড়ে। সংস্থাটির দাবি, সেই ত্রুটি সারানো হয়েছে। এরপর আর রাইজার পরীক্ষা হয়নি।
জানতে চাইলে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জনবলসংকটের কারণে সব লাইন নিয়মিত তদারক করা সম্ভব হয় না। তবে কেজিডিসিএলের ১৬টি পরিদর্শন দল রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে রাইজার ও লাইন পরিদর্শন করেছে।
গ্যাসলাইনে ছিদ্র ও ত্রুটির কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরে অন্তত পাঁচটি বিস্ফোরণের মধ্যে বড় দুর্ঘটনাটি হয় ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর নগরের পাথরঘাটায়। এতে নিহত হন ৭ জন। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ২৭ জানুয়ারি ২ জন, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ২ জন, ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর ১ জন এবং ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নিহত হন ২ জন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস সরবরাহের পুরো নেটওয়ার্ক বদলে ফেলা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এখন ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন পরিবর্তন করলে ঝুঁকি কিছুটা কমবে।