বছরজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ, তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের আঘাত সত্ত্বেও দেশে চালের উৎপাদন খুব বেশি কমেনি।
বছরের শুরুটা হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। গত জানুয়ারিতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল। পরে মার্চ থেকে প্রায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। ২৫ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। জুলাই-আগস্টজুড়ে ছিল সিলেট-ফেনীতে রেকর্ড বন্যা। এ ছাড়া মে মাসে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। আগস্টে ছিল ঘূর্ণিঝড় আসনার প্রভাব।
গত পাঁচ যুগে দেশে এক বছরে একসঙ্গে এতগুলো দুর্যোগ আঘাত হানার রেকর্ড নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে দুর্যোগকবলিত দেশের তালিকায় নবম বাংলাদেশ। আর এতসব দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ার বিপদের বড় শিকার দেশের কৃষি খাত। এ পরিস্থিতির মধ্যেও আমদানি ছাড়াই এ বছর দেশে চালের চাহিদা প্রায় শতভাগ মেটানো গেছে। ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যদিও দেশে খাদ্যের দাম বেড়েছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাড়ে ১৩ বছরের রেকর্ড গড়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত নভেম্বরে বিশ্বের দানাদার খাদ্যের উৎপাদন ও চাহিদাবিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে বৈরী আবহাওয়াকে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করা হয়েছে। একের পর এক দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন পূর্বাভাসের তুলনায় চার লাখ টন কম হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা—ইউএসডিএ। সবজি ও ফলের উৎপাদনের ওপরও এ বছর বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব পড়ে।
■ দুর্যোগকবলিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম। ■ ৪৬% মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত। ■ খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাড়ে ১৩ বছরের রেকর্ড।
চলতি বছর দুর্যোগের কারণে কোন দেশের কী পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করা হয় বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদন ২০২৪। এতে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। এ বছর বাংলাদেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাদের ৪৮ শতাংশের এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই। ওই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই গ্রামীণ এবং কৃষক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ফজলুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছর একাধিক দুর্যোগ আঘাত হানে। তবে এ বছর সংখ্যায় ছিল বেশি, শক্তিও ছিল প্রবল। কিন্তু ফেনী-নোয়াখালীর বন্যার পর আমরা দেখেছি, দেশের সাধারণ মানুষ বন্যার্তদের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যার পরে আমরা কৃষকের সহায়তার পাশাপাশি প্রায় বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছি। কৃষকেরা সঠিক সময়ে তা পরিশোধ তো করেছেই, একই সঙ্গে তাদের সঞ্চয়ও বাড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে চাল আমদানি না করেই দেশের চালের চাহিদা মেটানো গেছে। এটা অনেক বড় সফলতা।’
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ধান চাষিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তির দিক উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি বছর পাঁচ দফা বন্যার কারণে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু দেশের যেসব এলাকায় বন্যা হয়নি, সেখানে উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে। এ বছর আমনে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় তিন টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। যে কারণে সামগ্রিকভাবে চালের উৎপাদন খুব বেশি কমেনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে চলতি বছর কৃষকের জন্য তাই একই সঙ্গে বিপদ আর সফলতারও বছর। তবে ওই বিপদের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। চলতি বছরের শুরুতে মোটা প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ৫০ টাকার নিচে। বছর শেষে চলতি মাসে তা বেড়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। আর সরু চালের কেজি তো সর্বোচ্চ ৮০ টাকায় পৌঁছেছে। দামের এই বাড়ন্ত পরিস্থিতি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে।
এ ধরনের দুর্যোগের বছরে বাংলাদেশ সাধারণত বিদেশ থেকে চাল-গম আমদানি বাড়িয়ে দেয়। চালের ক্ষেত্রে হয় ভারত, না হয় থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের বাজার থেকে বাংলাদেশের বাজারের চেয়ে কম দামে চাল পাওয়া যায়। আর গমের জন্য থাকে ভারত ও রাশিয়া-ইউক্রেনের বাজার। কিন্তু দুই বছর ধরে ভারতের চাল-গমের বাজার বন্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গমের দাম বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য ওই দুই বাজার থেকে চাল-গম আমদানি কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সাধারণত বাংলাদেশ প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ লাখ টন চাল এবং ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। এ বছর বাংলাদেশ চাল আমদানি করেছে খুবই কম। বিশ্ববাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় সরকার এ বছর শুল্ক কমানোর পরও সেভাবে চাল আমদানি করেননি ব্যবসায়ীরা। তাই সরকার খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাজারে কিছুটা ঘাটতি থাকায় এ বছর বাংলাদেশে চাল-গমের দাম বেশি বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
এ ব্যাপারে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে যেসব দুর্যোগ বাড়ছে, তাতে কৃষি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে, তা এ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারলাম। তবে একই সঙ্গে আমাদের কৃষি খাত এত দুর্যোগের পরও যে সফলতা দেখিয়েছে, তা আমাদের নতুন করে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা দেখছি, দেশে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে। জুলাই বিপ্লবের পরও কৃষি উপকরণ এবং খাদ্যপণ্যের বাজারে পুরোনো অলিগার্করা (লুটেরা গোষ্ঠী) রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমাদের নীতি মহলের মনোযোগ দেওয়া উচিত।’