আমরা যারা একাত্তরে মুক্তির সংগ্রাম দেখিনি, তারা মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য কাকে বলে, সেটা বুঝি বিমূর্তভাবে। কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার যেসব বয়ান আমরা পাঠ করি, সেসব সমরূপ না হওয়ায় আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল, তা নানা রূপ বয়ানে প্রতিভাত হয়। সেসব বয়ান, বৃহৎ বা ক্ষুদ্র মিলেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বয়ান। অনেকটা শিল্পীর ফ্রেসকোর মতো বা কারিগরের হাতে তৈরি ছাইরঙা সিমেন্টে রঙিন কাচের ভাঙা টুকরার মোজাইকের মতো। তার ভেতর থেকে আমাদের কাছে সবচেয়ে গ্রাহ্য বয়ানটিকেই আমরা আমাদের জীবনে দেখতে চাই। সেখানেই তো মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য।
তবে আমার কাছে সবচেয়ে গ্রাহ্য বয়ান কোনটি হবে, সেটা কেবলই ব্যক্তি আমার রুচিনির্ভর আকস্মিক ঘটনা নয়; সেটা আমার তথাকথিত রুচি, আমার শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতিসত্তা, ধর্ম, যৌনতা, শিক্ষা, দারিদ্র্য ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের ৫০ বছর পার করে একজন নাগরিকের মনে সহজাত প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এমন মুক্তি চেয়েছিলাম? সঙ্গে সম্পূরক জিজ্ঞাসা, এই ‘আমরা’ কারা (আমি তো তখন জন্মাইইনি) বা ‘মুক্তি’ কী, কিংবা চাইলেই তা পাওয়া যায় কিনা ইত্যাদি।
দুই অর্থনীতির তত্ত্ব যেমন মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিকতা দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের যৌক্তিকতার জোগান দিয়েছিল, তেমন ক্রিয়াবাদীরা বলেছিলেন সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ এসেছে, যা জনযুদ্ধ হয়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন বা প্রয়োজনে করা মানুষের লড়াইকে এক লক্ষ্যের দিকে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে। ভিন্ন স্বর-স্বপ্ন-প্রয়োজনকে একবিন্দুতে মেলাতে গেলে আড়াল বা আভরণের প্রয়োজন পড়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতার জোগান তাই খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্মাণের চেষ্টায়ও। তবে দিন শেষে যুদ্ধ একটা সহিংস ঘটনা। এর মাঝখানে ওলটপালট হয়ে যায় মানবিক দুনিয়া। একাত্তরে ধ্বংস আর হত্যার হোলিতে বহু প্রাণের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়ের ৫০ বছর পার করে সেই ঘটনার তাৎপর্য যদি বুঝতে চাই, তাহলে বিমূর্ততা ছেড়ে ফিরতে হবে বাস্তবতার জমিনে।
নাগরিকের মুক্তির জন্য জনগণের যুদ্ধের মূল তাগিদ বা চাহিদাগুলো রাষ্ট্র পূরণ করতে পেরেছে কি না, খুঁজে দেখি সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের যেসব অধিকার দিয়েছে, পাঁচ দশক পার করেও তার সবটা অর্জিত হয়নি। শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা-লিঙ্গ পরিচয়ে নাগরিকে নাগরিকে ভেদ করার সুযোগ খাতায় না থাকলেও হাটে-মাঠে দিব্যি দৃশ্যমান। কথা বলার স্বাধীনতা, আদিবাসীর অধিকার, নারীর অধিকার অর্জিত হয়নি, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি আসেনি। সব মানুষকে তার অনন্ত সম্ভাবনার সবটুকু ব্যবহার করতে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়নি।
সরকার রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ এবং রাজনৈতিক দল সরকার হিসেবে নির্বাচিত হয় মাত্র, দল আর সরকার সমার্থক নয়—এসব খুব গোড়ার কথাও এখনো এ দেশের রাজনৈতিক দল, সরকার বা রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর শেখা হয়ে ওঠেনি, সুশাসনের অভাব সর্বত্র। বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রান্তে অবস্থিত দেশ হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি নব্য উদারবাদী নীতির মান্যতা দিতে আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে একেবারেই পুঁজির মালিকের আজ্ঞাবহ করে রাখে।
মালিকের মুনাফার দুনিয়া টঙ্গীর ভাদাম থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত ব্যপ্ত। অতিমারি পেরিয়ে টিকে থাকা বিশ্বব্যবস্থায় বড় পুঁজির উত্থানের সঙ্গে বৈষম্য আর অভাবের হাঁ-করা মুখ এগিয়ে আসছে, যার জন্য ন্যূনতম প্রস্তুতি রাষ্ট্রের নেই; যেমন ছিল না মারি মোকাবিলায়ও। খাদ্যের অভাব পুরো মেটেনি; যুক্ত হয়েছে অনিরাপদ খাদ্যের চাপ, ভয়াবহ পরিবেশদূষণ, শিল্পায়নের চাপে বন ধ্বংস-পরিবেশ ধ্বংস। অথচ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নিরাপদ খাদ্য-পানির সুযোগের অভাব ঘোচেনি।
সমাজে একটি মধ্যশ্রেণির বিকাশ ঘটেছে, যারা বাজার অর্থনীতির জিডিপির হিসাবে এগিয়ে গেলেও শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যের সুযোগে পিছিয়ে থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিদের ভবিষ্যতের স্বপ্নসাধ বাংলাদেশের বাইরে পাশ্চাত্যের চকচকে দুনিয়ায়। ফলে দেশের মেধা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। পাচার হয়ে যাচ্ছে অর্থ।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাড়াও কম দক্ষ শ্রমিকেরা যাচ্ছেন পরবাসে, আনছেন বৈদেশিক মুদ্রা, ভিত্তি দিচ্ছেন আমাদের অর্থনীতিকে। আবার মুদ্রার সঙ্গে তাঁরা এ দেশে বয়ে আনছেন মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ, যা পাল্টে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তৈরি সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে। এ নতুন সংস্কৃতির ধারকদের সঙ্গে পুরোনো আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব পরিষ্কার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের সমাজের মধ্যে দুই যুযুধান অংশকে—উঠতি মধ্যশ্রেণি মুখোমুখি পুরোনো মধ্যশ্রেণিকে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমাদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতির এ নতুন রূপ কী চেহারা নেবে, তা আমাদের উঠতি মধ্যশ্রেণির যুবাদের দ্বারাই নির্ধারিত হবে বলে মনে হয়। ব্যক্তির জীবনে মুক্তি হয়তো সম্ভব কেবল প্রয়াণে, নির্বাণ যখন সকল মোহ থেকে। তবে ব্যক্তিক মোহমুক্ত এমন একটা সমাজ যদি নির্মিত হয়, যেখানে যৌথতাকে, শ্রমজীবীর ঘামকে, প্রাণ-প্রকৃতিকে আর সাম্যের অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য তাহলে একালেও খুঁজে পাওয়া যাবে।
সামিনা লুৎফা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।