বরগুনায় প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডারকে হেনস্তা, ভিডিও ভাইরাল

বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুর রশিদ মিয়াকে প্রকাশ্যে হেনস্তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছড়িয়ে পড়েছে
ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আবদুর রশিদ মিয়াকে প্রকাশ্যে হেনস্তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ফেসবুকে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনের বটতলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদের হাত ধরে জেরা করছেন এক যুবক। এ সময় আবদুর রশিদের উদ্দেশে ওই যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘এই দেখেন কালা রশিদ, ডাকাত রশিদ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এই লোক শম্ভু বাবুকে (সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু) নিয়ে বরগুনার সাধারণ মানুষের ক্ষতি করেছেন। জমি দখল করেছেন। আসল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে টাকা খেয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করেছেন।’

এ সময় আবদুর রশিকে বলতে শোনা যায়, এমন কিছু হয়ে থাকলে তাঁদের বের করে দেওয়া হোক। তখন ওই যুবক বলেন, ‘আপনি তালিকা করতে টাকা নিয়েছেন।’ একপর্যায়ে আবদুর রশিদকে ধাক্কা দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন ওই যুবক। এ সময় পাশ থেকে আরেক যুবক তাঁকে নির্বৃত্ত করতে গেলে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেন। এরপর আবদুর রশিদের চোখে থাকা চশমাটি খুলে ছুড়ে ফেলে দেন ওই যুবক। রশিদ চশমাটি তুলতে গেলে তাঁর মাথায় চড় মারেন। এতে তাঁর মাথায় থাকা টুপি ছিটকে পড়ে। পরে সেটি তুলতে গেলে আবার চড় মারেন ওই যুবক। এরপর আবদুর রশিদকে ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণ তিনি সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত চার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুর রশিদকে হেনস্তাকারী ওই যুবকের নাম শাওন মোল্লা। তিনি জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম ওরফে ফারুক মোল্লার ছেলে। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় সহশ্রম বিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ-উজ-জামান ওরফে মামুন মোল্লার আপন চাচতো ভাই।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর প্রভাবে প্রশাসনের সর্বত্র প্রভাব খাটানোর অভিযোগ আছে আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা, ঘর বিতরণসহ সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানে তিনি একক কর্তৃত্ব খাটাতেন। একই সঙ্গে প্রভাব খাটিয়ে জেলা ডায়াবেটিক সমিতি, বরগুনা সদর ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদও আঁকড়ে ছিলেন তিনি। প্রভাবের কারণে তাঁর এসব বিতর্কিত ভূমিকার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারেননি।

জানতে চাইলে আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ বেলা ১১টার দিকে আমি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যাই। সেখানে বিএনপির নেতা মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লার ছেলে শাওন মোল্লাসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিল। আমাকে শাওন ডেকে বাইরে নিয়ে যায়। এরপর আমাকে নানা ভাষায় গালাগালি করে। সেখানে অনেক লোক ছিল। আমি এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নেব।’

এ বিষয়ে শাওন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলের একজন নেতাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করার বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তাঁর (রশিদ) সঙ্গে আমার বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তাঁকে আমি মারধর করি। এ ছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আমার বাবার নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের দালাল হিসেবে পরিচিত।’

ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুর রশিদকে মারধর করা হয়েছে বলে শুনেছি। একজন বৃদ্ধ মানুষকে মারধরের বিষয়টি কেমন জানি হলো।’ এর বেশি তিনি মন্তব্য করেননি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবুদর রশিদকে হেনস্তার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অনেকেই বিষয়টিকে নিন্দনীয় ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করছেন।

জেলা পাবলিক পলিসির আহ্বায়ক হাসানুর রহমান লিখেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের ব্যবহারে অনেকে ব্যথিত। কিন্তু তার জন্য তাঁকে প্রকাশ্যে এমন মারধর করাটা খুবই নিন্দনীয় কাজ হয়েছে। তিনি অপরাধী হলে আইন-আদালত আছে। এভাবে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে মারধর করা ঠিক হয়নি।’

জেলা বিএনপির নেতারা জানান, আবদুর রশিদ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার থাকার সময় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ বেশ কয়েকজন নেতার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর সুপারিশে কয়েকজন বিএনপির নেতার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকে সম্ভবত এটা হয়েছে।

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব মৃধা বলেন, ‘একজন বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে এমনটা না হলেই ভালো হতো। তিনি যদি অপরাধ করে থাকেন, সে জন্য আইন আছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।’