প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com
আমার ছোটবেলা থেকে বড়বেলা বা চাকরিতে প্রবেশের আগে পর্যন্ত, নিজের গ্রামের বাড়ি কোথায়, এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে খুবই কম সময়। মাঝেমধ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ঠিকানা লেখার সময় বাবার শিখিয়ে দেওয়া ঠিকানা গ্রাম, পোস্ট অফিস, থানা ও জেলা খুব মনোযোগ দিয়ে লিখতাম, যেন বানান ভুল না হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফার লেটার পেয়ে যখন রিপোর্ট করতে যাই, তখন একটা প্রশ্ন প্রায় সবাই একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন। প্রশ্নটি ছিল, ‘আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’ আমি যখনই বলছি ময়মনসিংহ, তখনই মুখটা বিমর্ষ করে প্রায় প্রত্যেকেই ভ্রু কুঞ্চন করছিলেন। আর আমি অপ্রস্তুত হচ্ছিলাম, কারও কারও শরীরী ভাষা আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছিল। পরে অবশ্য এর কারণ জেনেছিলাম। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সিবিএতে ময়মনসিংহের অধিবাসী এক নেতার খুব দাপট ছিল। অফিসার ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা তাঁর ওপর বেজায় নাখোশ ছিলেন। সেই ময়মনসিংহ এলাকার এক নারী বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করছে, এটা কেউই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি হয়তো।
আরও বিপত্তি ঘটল তখন, যখন আমি আমার রিপোর্টিং–সংক্রান্ত নির্ধারিত ফরমে জেলার নাম ময়মনসিংহ লিখলাম। দায়িত্বরত সহকারী পরিচালক বললেন, ‘আপনি তো বিবাহিত, কিন্তু জেলা লিখেছেন ময়মনসিংহ, এখানে আপনার শ্বশুরবাড়ির জেলা লিখতে হবে।’ আমি যখন ময়মনসিংহ কেটে মাগুরা লিখলাম, তিনি হায় হায় করে উঠলেন, বললেন, ‘চাকরি তো পেয়েছেন ময়মনসিংহ কোটায় আর শ্বশুরবাড়ি মাগুরায়। মাগুরা জেলার কোটা তো খালি নেই। এখন কী হবে?’ আমি নিজ জেলার বাইরে প্রথম অন্যের জেলার পরিচিতি দিয়ে আরও বিপদে পড়ে যাই। পরে বড়কর্তার ব্যাখ্যা ও নির্দেশে আমার যোগদানপত্র গৃহীত হলো বটে, কিন্তু আমার মনে নিজ জেলার নাম নিয়ে একটা ভয় ঢুকে গেল।
আজ অনেক বছর, অর্থাৎ প্রায় ২৭ বছর পর আবার নিজের বাড়ি কোথায়, এই প্রশ্ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে চলে এল, যখন আমার প্রিয় বাবা ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে রাতে হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার বড় সন্তান হিসেবে সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন আব্বার কোথায় চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য। আমার ছোট বোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কান্নারত অবস্থায় অনুরোধ করল, ‘প্লিজ আপা, আব্বুকে ঢাকায় রাখো, যা টাকা লাগবে, আমি দেব।’ সেজ ভাই বাবাকে তাঁর নিজের বাড়ি ময়মনসিংহের কবরস্থানেই নেওয়ার কথা জোর দিয়ে জানাল। ছোট ভাই, মা, আমার দুই বোনজামাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত। এরই মধ্যে প্রবাসী ভাই, যার কাছে আব্বার যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট পর্যন্ত কেনা হয়েছিল, সে প্রচণ্ড আহত ও অশ্রুভেজা কণ্ঠে কোনোমতে ফোনে বলতে পারল, ‘আব্বার শেষ ইচ্ছানুযায়ী কাজ করো।’
আমি যখন তাদের কাছে জানতে চাইলাম, ঢাকায় আব্বাকে দাফন করলে তাঁর বাড়ির আত্মীয়স্বজন তাঁকে একনজর কীভাবে দেখবে। বোন বলল, দেখবে না। বোনের এককথায় আমার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হলো। আমি বললাম, যে বাবা আমাদের পাঁচ ভাইবোনের চেয়ে তাঁর নিজের বাড়ির মানুষদের বেশি ভালোবাসতেন, তাঁর মুখখানা শেষবারের মতো তাঁর গ্রামের আত্মীয়স্বজন একবার দেখবে না, তা তো হবে না। আব্বার কবর তাঁর নিজ বাড়িতে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ভায়াবহ গ্রামে তাঁর মা–বাবার সঙ্গেই হবে।
প্রথমে লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যান, পরে আমাদের তিনটি গাড়ি একে একে বাড়ির পথে চলছে। সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হবে মর্মে উপস্থিত এক মামা রায় দিলেন। আব্বা তাঁর নিজের কর্মস্থল সিলেটের ছাতক থেকে প্রায় তিন দিনের ট্রেন ও বাস ভ্রমণ শেষে কীভাবে কত কষ্ট স্বীকার করে আমাদের ভালুকায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসতেন, সেসব দিনের কথা মনে পড়ে বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। অজপাড়াগাঁয়ের বিদ্যুৎ আর সামান্য অবকাঠামোবঞ্চিত এক পল্লি জনপদ, যেখানে আমার দাদা-দাদি ও চাচারা থাকতেন। অনেক সময় পড়ালেখা নষ্ট হওয়ার অজুহাতে আমরা গ্রামে আসতে আগ্রহী না হলে বাবা বলতেন, ‘শিকড় ছেড়ে দিয়ো না। এখানে তোমার পিতৃপুরুষের ঠিকানা, এটাকে ধরে রেখো।’
গ্রামের হাজারখানেক মানুষ কোথা থেকে খবর পেলেন, সারি বেঁধে, লাইন ধরে তাঁরা স্রোতের মতো আমাদের বাড়ির দিকে আসতে থাকলেন। হাজারখানেক লোক জানাজায় এসেছেন বলে শুনেছি। কাউকে মুখে চিনি, কাউকে চিনি না, বৃষ্টিভেজা লাল মাটির পিচ্ছিল পথ ধরে তাঁরা এলেন।
কবর দেওয়া শেষ হলে অনেকেই বাড়িতে মা ও আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমি বুঝেই উঠতে পারলাম না আব্বার প্রতি তাঁদের এ ভালোবাসা আমার অজানা ছিল কীভাবে। যখন সবাই বিদায় নিচ্ছেন, আমি তাঁদের উদ্দেশে কেবল বললাম, ‘আমার বাবা আপনাদের খুব ভালোবাসতেন, তাই তাঁকে আপনাদের কাছেই রেখে গেলাম।’
এর পর থেকে দিনে অন্তত একবার মানসপটে ভাসে আমার বাবার স্থায়ী ঠিকানা, আমি কয়েকবার সশরীর কবর জিয়ারত করতে গিয়েছি, কিন্তু এখন যাই মনের বাড়িতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে। প্রতিদিন অন্তত একবার নামাজের পরে সুরা ফাতিহা পাঠ করে দোয়া করি।
এভাবেই আমার প্রিয় বাবার বাড়ি ও আমার একসময়ের স্থায়ী ঠিকানা আবার আমার অস্তিত্বে সুদৃঢ় জায়গা করে নেয়। আর আমার বাবার বাড়ি ময়মনসিংহ—এ কথা উচ্চারণে গভীর মমত্ব অনুভব করতে থাকি।
হোসনে আরা আজিজ, মিন্টো রোড, ঢাকা