দেশভাগের পর একটি সৃজনশীল প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে পঞ্চাশের দশকে। তাঁরা দেশের উন্নয়নের ভিত হয়ে দাঁড়ান। আর এই ভিত গড়ার মিছিলে মুসলিম নারীরাও অবদান রেখেছেন। ওই সময় মুসলিম নারীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়া সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই, প্রতিকূলতা পেরিয়ে যাঁরা শিক্ষায় সম্পৃক্ত হয়েছেন, তাঁরা স্বকীয়তা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। সেই নারীদের মধ্যে ছিলেন নূরজাহান মুরশিদও। নারী জাগরণের অন্যতম নেত্রী, রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নূরজাহান মুরশিদের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত এক স্মারক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
বাংলা একাডেমিতে কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘উত্তরসূরি: নূরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ এই স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে। স্মারক বক্তৃতার শিরোনাম ‘মুর্শিদাবাদ অনুষঙ্গ ও বিশ শতকের নারী জাগরণ’। সভায় দেশভাগের সময় ভারতের মুর্শিদাবাদের মেয়ে নূরজাহান মুরশিদের এ দেশে চলে আসা, শিক্ষকতা করা ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখার কথা উঠে আসে। নূরজাহান মুরশিদ বরিশালের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরে যোগ দেন রেডিও ইন্ডিয়ায়। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলেরও শিক্ষক ছিলেন। সভায় দেশের বিকাশে গবেষণায় তরুণদের আগ্রহী করে তুলতে বাংলা একাডেমিকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, বাংলা একাডেমি গবেষণার জন্য বৃত্তি দিয়ে থাকে। শুধু বাংলা একাডেমি নয়, দেশের যেকোনো শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত।
‘মুর্শিদাবাদ অনুষঙ্গ ও বিশ শতকের নারী জাগরণ’ বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের আঞ্চলিক ইতিহাস–গবেষক হাসিবুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ শতকের নারী জাগরণ বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। শিক্ষার সঙ্গে জাগরণের সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষা খুব একটা সহজ ছিল না। গৃহে ধর্মশিক্ষা ও আরবি-ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো উদ্যোগ ছিল না। নারী জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নুরন্নেসা খাতুন বিদ্যা বিনোদিনী, খায়রুন্নেসা, ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, তাহেরুন্নেসা মুসলিম নারীদের জন্য কলম ধরেছেন। পুরো বঙ্গের মধ্যে মুর্শিদাবাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ছিল। নূরজাহান মুরশিদের মতো মুর্শিদাবাদের উত্তরাধিকারীরা বাংলাদেশে রয়েছেন। দেশভাগের সময় মুসলিম সমাজের প্রভাবশালীরা এ দেশে চলে আসেন। নূরজাহান মুরশিদও তাঁদের একজন। তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। দেশ বলতে তিনি মানুষকে বুঝতেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ ও দেশ গঠনে তিনি মানুষের পাশে থেকে কাজ করেছেন।
আরেক বক্তা মুর্শিদাবাদ ইতিহাস চর্চাকেন্দ্রের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, কলকাতার প্রধান প্রধান মহিলা কলেজে মেয়েদের ভর্তির সুযোগ ছিল না। ১৯২৩ সালে বেথুন কলেজে প্রথম মুসলিম ছাত্রী হিসেবে ফজিলাতুন্নেসা ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে মুসলিম মেয়েদের উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে যায়। মুসলিম নারীশিক্ষা বিস্তারের অন্যতম প্রধান অন্তরায় ছিল পুরুষতান্ত্রিক অবরোধ। অথচ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষার প্রতি নারীদের অনাগ্রহ ছিল না। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অবস্থান করেও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, চিন্তার জগতে নানা পরিবর্তন এলেও মুসলিম নারী জাগরণ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। লিঙ্গবৈষম্যের চিরাচরিত জড়তা এখনো মুসলিম নারী প্রগতির প্রধান অন্তরায়।
আয়োজক সংগঠনের মহাসচিব এবং নূরজাহান মুরশিদ ও খান সারওয়ার মুরশিদের মেয়ে শারমীন মুরশিদ সভাটি সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, পঞ্চাশ দশকের প্রজন্ম যুক্তিভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা চেতনা, নৈতিকতা, সৃজনশীলতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধ স্থাপন করে নতুন দেশের জন্ম দেন। এ দেশ নিজের সংস্কৃতি, দর্শন ও স্বকীয়তা নিয়ে বড় হচ্ছে। পঞ্চাশ দশকের সেই আলোকিত প্রজন্মের প্রতিনিধি নূরজাহান মুরশিদ। উত্তরসূরি সংগঠন সেই প্রজন্মের কৃতিত্ব সংরক্ষণের জন্য তাঁদের নিয়ে মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও ইতিহাস–গবেষক অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিন। নৃত্যনন্দন এবং সমগীত গানের দল অনুষ্ঠানে নাচ ও গান পরিবেশন করে।