দেশে কম ও বেশি বয়সী নারীদের ‘ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতে’ মেয়েশিশুর ভ্রূণ বেশি

দেশে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ও ৪৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত করা ভ্রূণের মধ্যে মেয়েশিশুর হার বেশি। তবে নারীদের মোট ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর ভ্রূণ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) ২০২৩’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গত ২৬ আগস্ট।

প্রতিবেদনে নারীদের মাসিক নিয়মিতকরণ (এমআর) প্রক্রিয়াকে ‘ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত’ ও গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাহের আগে গর্ভপাতকে ‘অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা প্রতিবেদনের গর্ভপাত অংশটিকে পূর্ণাঙ্গ নয় এবং কিসের ভিত্তিতে ভ্রূণ ছেলে বা মেয়েশিশুর বলে শনাক্ত করা হয়েছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, যে সময় পর্যন্ত এমআর বৈধ, সেই সময় পর্যন্ত আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে এই মায়েরা অনিরাপদ গর্ভপাতের দিকে ঝুঁকেছিলেন কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর অপরিপূর্ণ চাহিদার কারণেও অনেকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হন।

সমাজে ছেলেসন্তান পছন্দের অগ্রাধিকারে থাকায় মেয়েশিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত করানোর ঘটনা ভারত, চীন ও নেপালে বেশি ঘটে থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে কি না, তা পর্যবেক্ষণে রাখার কথা কয়েক বছর ধরে বলছেন প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। সে কারণে গত বছর থেকে গর্ভপাত বিষয়ে প্রতিবেদনে মাঠপর্যায়ের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বিবিএস।

এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মাতৃগর্ভে থাকা সন্তানের লিঙ্গপরিচয় প্রকাশ না করতে আদেশ দিয়েছেন। চার বছর আগে করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলো যাতে গর্ভাবস্থায় লিঙ্গপরিচয় শনাক্তকরণকে নিরুৎসাহিত করে এবং এ–সংক্রান্ত জাতীয় নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৬ ধারায় গর্ভপাত বিষয়ে বলা আছে, মায়ের জীবন রক্ষার প্রয়োজন ছাড়া গর্ভপাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সরকার ১৯৭৯ সালে এমআরকে বৈধ ঘোষণা করে। মাসিক বন্ধ থাকলে ১০ সপ্তাহের মধ্যে প্যারামেডিকদের দিয়ে ও ১২ সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসকদের মাধ্যমে এমআর করা বৈধ। এমআর ও গর্ভপাত–পরবর্তী সেবা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জাতীয় নির্দেশনা (গাইডলাইন) আছে।

গত দুই বছরের প্রতিবেদন থেকে লিঙ্গ নির্ধারণ করে গর্ভপাত করানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন।

প্রথম আলোকে তিনি বলেন, লিঙ্গ পছন্দ করে গর্ভপাত ঘটানো হচ্ছে—এ ধরনের আলোচনা শুরু হওয়ার কারণে এ বিষয়ও জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গর্ভপাতের বিষয়ে নারীরা যে তথ্য দিয়েছেন, সেটিই শুধু জরিপে তুলে আনা হয়েছে। এখানে মেডিকেল বা আইনি কোনো প্রক্রিয়া দেখা হয়নি।

যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকারবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘গাটমাকার ইনস্টিটিউট’ বাংলাদেশ বিষয়ে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের তথ্য দিয়েছে। সে অনুযায়ী, ওই সময় বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৫৩ লাখ ৩০ হাজার গর্ভধারণ হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ লাখ ৩০ হাজার গর্ভধারণই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। ফলে বছরে ১৫ লাখ ৮০ হাজার গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে।

প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে

এসভিআরএস ২০২৩ প্রতিবেদনে গর্ভধারণ করা নারীদের বয়স ১০ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত হয়েছে—এমন নারীদের ৫৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা জানতেন না ভ্রূণের লিঙ্গ কী ছিল। প্রায় ৫ শতাংশ নারী কোনো উত্তর দেননি।

ভ্রূণের লিঙ্গ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট গর্ভপাত করা ভ্রূণের প্রায় ২২ শতাংশ ছেলেশিশুর ও ১৭ শতাংশ মেয়েশিশুর। যমজ ভ্রূণের হার ১ শতাংশের কম। তবে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত মায়েদের ও ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মায়েদের ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশুর ভ্রূণ বেশি ছিল। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত মায়েদের গর্ভপাত করা ভ্রূণের প্রায় ৯ শতাংশ ছেলেশিশুর ও ১৪ শতাংশ মেয়েশিশুর। আর ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের গর্ভপাত করা ভ্রূণের মধ্যে মেয়েশিশুর হার প্রায় ১২ শতাংশ। একই বয়সী গ্রুপে ছেলেশিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত হয়নি।

এদিকে ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত করা ভ্রূণের লিঙ্গ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর প্রায় ২৩ শতাংশ ছেলেশিশুর ও ১৮ শতাংশ মেয়েশিশুর ছিল। তবে ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশুর ভ্রূণ বেশি ছিল।

বিশেষজ্ঞদের মত

স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, জীবনাশঙ্কা থাকলে মায়ের সম্মতিতে চিকিৎসক গর্ভের যেকোনো সময়ে গর্ভপাত ঘটাতে পারেন। তবে ২০ সপ্তাহের আগে আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায় না। এর বাইরে ভ্রূণের জেনেটিক বা ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করার জন্য বা জটিল গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে ‘অ্যামনিওসেন্টেসিস’ করে ক্রোমোজম পরীক্ষা করা যায়। এর মাধ্যমে ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ করা গেলেও তা বাংলাদেশে ব্যয়বহুল এবং ততটা সহজলভ্যও নয়।

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের ভ্রূণের স্বাভাবিক গর্ভপাত হলে লিঙ্গ বোঝা যায়। তবে এমআর করা হলে লিঙ্গ বোঝা যায় না। তিনি আরও বলেন, ‘জরিপটা আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ লাগছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্রূণ ছেলে বা মেয়েশিশুর ছিল কি না, জরিপকারীরা তা কীভাবে নির্ধারণ করেছেন? আর সেটি কি বিজ্ঞানসম্মত ছিল?’

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাবিজ্ঞান বিভাগ ২০১৮ সালে ‘এক্সপ্লোরিং জেন্ডার বায়াসড সেক্স সিলেকশন ইন বাংলাদেশ: আ রিভিউ অব দ্য সিচুয়েশন’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদন অনুসারে, গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনা, শারীরিক জটিলতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে ১২ সপ্তাহের পর গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন তাঁরা। ২৮ শতাংশ নারী জানিয়েছিলেন, প্রথম সন্তান ছেলেই পছন্দ তাঁদের। এ ছাড়া, ৪০ শতাংশের বেশি নারী ভ্রূণের লিঙ্গ জানতে আলট্রাসনোগ্রাফি করেছিলেন।

ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ কার্যালয়ের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এ জরিপে পরিবারগুলোয় গিয়ে শুধু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে জরিপে তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হতো। একজন নারী ২০ সপ্তাহের পর অনিরাপদ গর্ভপাত ঘটিয়েছেন কি না, সেটাও স্পষ্ট হয়নি জরিপ থেকে।

আবু সাইদ হাসান আরও বলেন, এ দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে অনেক নারী মাসিক বন্ধ হওয়ামাত্রই গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করান না। দেখা যায়, গর্ভাবস্থা শনাক্ত করতেই ১৫ সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। অনেকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা গর্ভপাত ঘটালে ভ্রূণ ছেলে নাকি মেয়ে, সেটা প্রাধান্য পায় না। তাঁর মতে, সমাজে ছেলেসন্তান পছন্দের অগ্রাধিকারে থাকলেও ভারত, চীন বা নেপালের মতো মেয়েশিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত করানোর মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে এখনো নেই। তবে এ অবস্থা যেন তৈরি না হয়, সে জন্য এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।