রাজধানীর ১২১ লালবাগ রোডে খান মোহাম্মদ মিরধা মসজিদ। এটি ১৭০৪ বা ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে মসজিদটি
পবিত্র জোহরের নামাজের পরে সিঁড়ি বেয়ে মসজিদ থেকে নেমে আসছিলেন সহকারী ইমাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন পুরান ঢাকার ৩১৯ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক খান মোহাম্মদ মিরধার মসজিদে মুয়াজ্জিন ও ইমাম হিসেবে। বহু গল্প জমে আছে তাঁর ঝুলিতে।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গত মঙ্গলবার মসজিদটি ঘুরে দেখাতে দেখাতে তার কিছু শোনালেন একটু একটু করে। একসময় নিচু স্বরে বললেন, এই মসজিদে কিন্তু ‘জিন’ও আছে। লালবাগ-আতিশখানা-আমলীগোলা এলাকায় লোকজনের কাছে যদি ‘জিনের মসজিদ’ যাওয়ার পথ জানতে চান, তাহলে তারা এই মসজিদে আসার পথ দেখিয়ে দেবে।
খান মোহাম্মদ মিরধার মসজিদটি ১২১ লালবাগ রোডে। তবে ইতিহাসের বই–পুস্তকে এর অবস্থান আতিশখানায় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আতিশখানা রোডটি মসজিদটির পাশেই। আগে মসজিদটি আতিশখানা মহল্লাতেই ছিল, তবে এখন পড়েছে লালবাগ অঞ্চলে। এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড। মহল্লাটির নামকরণ কেন আতিশখানা হলো, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতান্তর আছে। অধ্যাপক আবদুল করিম তাঁর ‘মোগল রাজধানী ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন লালবাগ দুর্গের কাছে এই এলাকায় মোগল আমলে অস্ত্রাগার গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই থেকে এলাকাটির নাম আতিশখানা হয়েছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনও এই মতকে যুক্তিসংগত বলে মনে করেন।
মসজিদের ভেতরে উত্তর–দক্ষিণে দুটি ছোট দরজা। পশ্চিমের দেয়ালে খিলান আকৃতির প্রধান মেহরাবের দুই পাশে একটি করে ছোট আকারে খিলান মেহরাব
তবে হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে, এই এলাকায় জরথ্রুস্ত্রের অনুসারী পারসিক বা সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহীর কোনো অনুসারী বসবাস করতেন। তাঁদের সূত্রেই এলাকার নাম হয়েছে আতিশখানা। হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ‘আসুদগান-ই-ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন, উনিশ শতকের শেষার্ধে আতিশখানা অঞ্চল বড় কবরস্থানে পরিণত হয়েছিল।
দিল্লির মসনদে তখন আসীন সম্রাট আওরঙ্গজেব। ঢাকার উপশাসনকর্তা ছিলেন ফরুকসিয়ার, যিনি পরে নবম মোগল সম্রাট হিসেবে মসনদে আসীন হয়েছিলেন এবং অত্যন্ত মর্মান্তিক মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তখন ঢাকার প্রধান বিচারক কাজী ইবাদুল্লার নির্দেশে আতিশখানায় এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন খান মোহাম্মদ মিরধা। মুনতাসীর মামুনের মতে, প্রাচীনত্বের দিক থেকে এটি ঢাকার সপ্তদশতম মসজিদ।
মসজিদের ভেতরে ফারসি ভাষায় লেখা শিলালিপিটি এখনো টিকে আছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে প্রধান কাজির নির্দেশে হিজরি ১১১৬ সালে খান মোহাম্মদ মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। সেই অনুসারে ১৭০৪ বা ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। নির্মাতা খান মোহাম্মদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায় না। শিলালিপিতে তাঁর নামের শেষ অংশের ‘মিরধা’ উল্লেখ নেই। কেমন করে খান মোহাম্মদের নামের সঙ্গে মিরধা যুক্ত হলো এবং তা প্রচলিত হলো, সে রহস্যের জট খোলেনি। মসজিদের সামনে একটি লাল ইট-সুরকি বাঁধানো প্রাচীন কবর রয়েছে। ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বইয়ের লেখক মুনশী রহমান আলী তায়েশের মতে, এটা খান মোহাম্মদ মিরধার সমাধি।
প্রায় তিন বিঘা জায়গা নিয়ে খান মোহাম্মদ মিরধা মসজিদ। পুরো জায়গা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সামনে প্রায় এক বিঘার মতো জায়গাজুড়ে বাগান। হরেক রকমের মৌসুমি ফুল ফুটে আছে। কিনার দিয়ে নারকেলগাছের সারি। তারপর খোলা চত্বরের মাঝখানে মসজিদের ভবন। দক্ষিণ দিকের চত্বরটি ঢালাই করা। এখানেও নামাজের জামাত হয়। উত্তর দিকের অংশে আম, কাঠবাদাম, বহেড়াসহ নানান ফলের গাছ।
মসজিদের ভেতরে ফারসি ভাষায় লেখা শিলালিপিটি এখনো টিকে আছে। তাতে উল্লেখ আছে হিজরি ১১১৬ সালে খান মোহাম্মদ মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। সেই অনুসারে ১৭০৪ বা ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়
মসজিদটি একটি ১৭ ফুট উঁচু বেদির ওপরে নির্মিত। ভূমি থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে মসজিদের বেদি পর্যন্ত। এই সিঁড়ি বেয়েই মসজিদে উঠতে হয়। মূল বেদি বা ছাদটি ১২৫ ফুট লম্বা, ১০০ প্রস্থ। পুরোনো মসজিদটি উত্তর–দক্ষিণে লম্বা। দৈর্ঘ্য ৪৮ ফুট, প্রস্থ ২৪ ফুট। মসজিদের উত্তরে আরেকটি ভবন রয়েছে। এতে আছে দুটি কক্ষ। এখানে সহকারী ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরা বসবাস করেন। অফিস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মূল মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার হয়। তাতে ৩০ জন করে ৯০ জন মুসল্লি জামাতে দাঁড়াতে পারেন। তবে ওপরের চত্বরে মসজিদের দুই পাশে, সামনে ও পেছনে এবং নিচে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণের চত্বরেও নামাজের জামাত হয়। সব মিলিয়ে দুই হাজারের মতো মুসল্লি জামাতে দাঁড়াতে পারেন।
এখন পবিত্র রমজানের শুরু থেকেই তারাবির জামাত হচ্ছে। সে জন্য মসজিদের দোতলার বেদির ওপরে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া হয়েছে। এতে ছাদের গম্বুজগুলো আর সামনে থেকে দেখা যায় না। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, খান মোহাম্মদ মিরধা মসজিদের স্থাপত্যরীতি অনেকটা বেগম বাজারের করতলব খান মসজিদের স্থাপত্যরীতির মতো। এর ছাদের মাঝে একটি বড় ও দুই পাশে একই আকারের একটু ছোট মোট তিনটি অলংকৃত গম্বুজ রয়েছে। আর চার কোণে চারটি বুরুজ।
এ ছাড়া সামনে ও পেছনের দেয়ালে ছয়টি সরু আকারের বুরুজ আছে। বরুজগুলোর চূড়া ‘বদ্ধ মিনার’ অলংকৃত।
মসজিদের ভেতরে উত্তর–দক্ষিণে দুটি ছোট দরজা। পশ্চিমের দেয়ালে খিলান আকৃতির প্রধান মেহরাবের দুই পাশে একটি করে ছোট আকারে খিলান মেহরাব। পূর্ব দিকে তিনটি দরাজ পশ্চিম দেয়ালের ঠিক মেহরাব বরাবর। এই দরজাগুলোর চৌকাঠ ও খিলানের উপরিভাগ কালো পাথরে তৈরি। এ ছাড়া ওপরের চত্বরের পূর্ব দিকের দেয়ালের দুই পাশে দুটি বড় আকারের বুরুজ রয়েছে, এর ওপরের অংশ ভাঙা।
মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ। তাদের দুটি সাইনবোর্ড আছে মসজিদের সামনে। মসজিদটির সর্বশেষ সংস্কার করেছে তারা প্রায় সাত বছর আগে।
এই মসজিদের স্থাপনা অভিনব। নিচের তলায় অর্থাৎ মূল বেদির নিচের অংশটি নিরেট। ভেতরে কী আছে জানার উপায় নেই। কারণ, ভিতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালজুড়ে ছোট ছোট ঘর। সামনে টানা বারান্দা। প্রতিটি ঘরের বারান্দার অংশ ছাদ থেকে খিলানের আকৃতি দিয়ে চিহ্নিত করা। এতে সারি সারি খিলানের পাশ দিয়ে আসা আলো–আঁধারিতে এক নান্দনিক দৃশ্যপট সৃষ্টি হয়। মুনশী রহমান আলী তায়েশ তাঁর ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, একসময় এসব ঘরে ঘোড়াসহ গবাদিপশু রাখা হতো। এখন এসব ঘরের কোনো কোনোটিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কারকাজের শ্রমিকেরা বাস করেন।
প্রবীণ সহকারী ইমাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ মসজিদটি ঘুরে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন জিনের গল্প। তিনি নিজেও অনেক বার গভীর রাতে মসজিদে তাদের নামাজ পড়তে দেখেছেন। তবে তাঁর সঙ্গে ওনারা কোনো খারাপ আচরণ করেননি। প্রয়াত এক মোতোয়ালি বাঘ চলাফেরা করতে দেখেছেন। এমন অনেকই অনেক কিছু দেখেছেন। এমনকি খাদেম জহুরুল ইসলামকে একবার গভীর রাতে মসজিদ থেকে জিনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
মসজিদের সামনে একটি লাল ইট-সুরকি বাঁধানো প্রাচীন কবর রয়েছে। ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বইয়ের লেখক মুনশী রহমান আলী তায়েশের মতে, এটা খান মোহাম্মদ মিরধার সমাধি
জহুরুল নিজেই বললেন তিন বছর আগের এক রাতের সেই ঘটনা। ২৮ বছর ধরে জহুরুল খাদেমের কাজ করেন এই মসজিদে। জিনের কথা অনেকে মুখেই শুনেছেন। তিনি অবশ্য আগে দেখেননি। সেদিন কোনো এক মুসল্লির সঙ্গে জিন দেখা নিয়ে তার বাদানুবাদ হয়েছিল। জিনদের সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু হয়তো বলে ছিলেন। তিনি মসজিদের চত্বরের ঘরটিতেই থাকেন। গভীর রাতে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তাঁর মনে হচ্ছিল কেউ যেন খুব জোরে কিলঘুষি দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখেন, পড়ে আছেন আমলীগোলা এলাকায় এক পথের পাশে।
আসলে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে, যা ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিতে সত্য, কিন্তু বস্তুনিষ্ঠভাবে সত্যতা যাচাই করার সর্বজনীন উপায় থাকে না। প্রাচীন এই মসজিদ ঘিরে তেমনই অনেক ঘটনার গল্প চালু আছে। গল্প চিরকাল গল্পই, ডালপালা মেলে কালক্রমে তা রহস্য ঘনীভূত করে তোলে, হয়ে ওঠে কিংবদন্তি।