পুলিশের উদ্যোগ

এক ক্লিকেই মামলার সব তথ্য, সুফল মিলছে যেভাবে

এর মধ্য দিয়ে পুলিশ সদস্যদের ফৌজদারি মামলাসংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

  • ২০১৫ সাল থেকে ঢাকা শহরের সব মামলার তথ্য সিডিএমএসে থাকছে।

  • জামিন থেকে শুরু করে বিচারপ্রক্রিয়ার সব তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

  • তথ্য সংরক্ষণে সিএমএম আদালতে পুলিশের ১০ সদস্য কাজ করছেন।

কোনো আসামির বিরুদ্ধে দেশের আর কোথাও কোনো মামলা আছে কি না, কোনো মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি বা সাজার রায় হয়েছে কি না—এসব তথ্য এখন এক ক্লিকেই জানতে পারছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা।

ফৌজদারি মামলাসংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থাপনায় পুলিশের কেন্দ্রীয় সফটওয়্যার ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিডিএমএস) সবকিছু সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিট এই সিস্টেমে মামলাসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। এই তথ্যভান্ডারকে আরও কার্যকর করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উদ্যোগে ফৌজদারি মামলার তথ্য সংরক্ষণে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১০ জন পুলিশ সদস্য সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে ঢাকা মহানগরে যেসব মামলা দায়ের হয়েছে, সেগুলোর এজাহারসহ সব ধরনের তথ্য সিডিএমএসে সংরক্ষণ করছেন তাঁরা। ঢাকা মহানগরে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, চুরি, প্রতারণা, জালিয়াতিসহ সব ধরনের মামলার তথ্য এতে সংরক্ষিত হচ্ছে।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ যে ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলেছে, সেটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে ফৌজদারি মামলার সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা জরুরি।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি)

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্রসহ বিচারসংক্রান্ত প্রায় সব ধরনের তথ্য সিডিএমএসে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেখানে ঢুকে যেকোনো অপরাধীর বিষয়ে যেকোনো তথ্য জানা সহজ হচ্ছে।

ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গণমাধ্যম) মো. মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের সবগুলো ইউনিটের জন্য মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ অপরাধের সব ধরনের তথ্য সিডিএমএসে সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। এক ডেটাবেজে অপরাধের সব তথ্য সংরক্ষণ করার কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য সহজে পাওয়া যাচ্ছে। অপরাধীর অপরাধ বৃত্তান্ত জানা থেকে শুরু করে সব ধরনের তথ্য জানা যাচ্ছে।

এর মধ্য দিয়ে ফৌজদারি মামলাসংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসছে বলে মনে করছেন তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ব্যক্তিরা। এ বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্টে সব ধরনের ফৌজদারি মামলার তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। এক ক্লিকে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণসহ সব ধরনের মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীর জবানবন্দি, আদালতের আদেশের সব তথ্য জানা সম্ভব হলে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম তদারকি সহজ হবে।

ডিএমপি যেভাবে তথ্য সংরক্ষণ করছে

ঢাকার আদালতে ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্টে তথ্য সংরক্ষণের কাজ তদারকির দায়িত্বে আছেন পুলিশের উপপরিদর্শক এল কে চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন ঢাকা মহানগরের থানাগুলোতে নতুন করে যত মামলা দায়ের হয়, সেগুলোর এজাহারের ই-কপি ডেটাবেজে তুলে দেওয়া হয়। আর এখানে পুলিশের একটি দল আদালতে মামলার বিচারসংক্রান্ত যত কার্যক্রম হচ্ছে, সেগুলো ডেটাবেজে সংরক্ষণ করছে।

এল কে চৌধুরী জানান, এ কাজের জন্য প্রায় দেড় বছর আগে সিএমএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে ৪০টি কম্পিউটার দেওয়া হয়। তাঁর নেতৃত্বে ১০ জন পুলিশ কনস্টেবল এসব কম্পিউটার ব্যবহার করে সিডিএমএসে তথ্য সংরক্ষণে কাজ করছেন।

সিডিএমএসে তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ফৌজদারি মামলায় আসামির জামিন মঞ্জুরের তারিখ, যে আদালত জামিন মঞ্জুর করলেন সেই আদালতের নাম, যিনি জামিনদার হলেন তাঁর নাম-ঠিকানা সিডিএমএসে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জামিনের তথ্যের পাশাপাশি মামলায় যেসব আলামত জব্দ করা হয়, সেই তালিকার তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির নামও সংরক্ষণ করা হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের সবগুলো ইউনিটের জন্য মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ অপরাধের সব ধরনের তথ্য সিডিএমএসে সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। এক ডেটাবেজে অপরাধের সব তথ্য সংর
মো. মনজুর রহমান, ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গণমাধ্যম)

যেভাবে সুফল পাওয়া যাচ্ছে

ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের সদস্যরা বলছেন, কোনো মামলার অভিযুক্ত আসামির অতীতের অপরাধের তথ্য সংগ্রহ জরুরি হয়ে পড়ে। আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে আসামির পিসিপিআর (পূর্বের মামলার পরিসংখ্যান) উল্লেখ করতে হয়। শুনানিতে আদালতও আসামি সম্পর্কে তথ্য জানতে চান।

এখন সিডিএমএসের সাহায্যে অভিযুক্ত ব্যক্তির আগের সব অপরাধের তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। একইভাবে কোনো আসামি জামিনে গিয়ে পলাতক হয়েছেন কি না, কত তারিখ থেকে জামিনে গিয়ে পলাতক, কত তারিখে আদালত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, সবই জানা যাচ্ছে। আবার সিডিএমএসের সাহায্যে মামলার সাক্ষীদেরও দ্রুত খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।

ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানাই ফৌজদারি মামলাসংক্রান্ত তথ্য সিডিএমএসে তুলে ধরে। সেখানে শুধু মামলার তথ্যই দেওয়া হয় না, অপরাধী সম্পর্কে তথ্য খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই সফটওয়্যারের সুবিধা নেওয়া হয় বলে জানান রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে সব ধরনের তথ্য খোঁজা হতো। আর এখন ক্লিক করে সহজে সিডিএমএস থেকে সব তথ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে আদালতে সিডিএমএসে তথ্য সংরক্ষণের কাজে যুক্ত থাকা তিনজন ব্যক্তি জানান, মাত্র ১০ জনের পক্ষে আদালতে মামলাসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য সিডিএমএসে সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এখানে লোকবল বাড়ানো গেলে ভালো হয়। এ বিষয়ে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ যে ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলেছে, সেটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে ফৌজদারি মামলার সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা জরুরি। পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে কার্যকর করে তুলতে হবে। তাহলে এই ব্যবস্থা পুলিশ ও আদালতের কাজে নানাভাবে সহযোগিতা করবে।