এবারের ‘বিশ্ব মা দিবস’ ছিল গত ১৪ মে। দিবসটিতে মাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আফিয়া জাহিন (৯) ছবি এঁকে একটি কার্ড বানিয়েছিল।
‘হ্যাপি মাদারস ডে’ লেখা এই কার্ডে আঁকা ছবিতে মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনছে এক শিশু। আরেক শিশু পাশেই দাঁড়িয়ে, তার মাথার চুল দুই ঝুঁটি করা। এই ছবিতে আফিয়া হয়তো নিজেকে আর তার চার বছর বয়সী বোন আয়রা জাহিরা ও মাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
আফিয়া তার ডায়েরিতে ইংরেজিতে নিজের স্বপ্নের কথা (মাই ড্রিম) লিখেছে—‘ট্রাভেল’ (ভ্রমণ)। সেখানে সে ছবিও এঁকেছে। এতে দেখা যায়, ছোট একটি মেয়ে ব্যাগ নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছে। ছবিতে উড়োজাহাজও আছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৪ আগস্ট আফিয়া এক অজানা ভ্রমণে বের হয়েছে, যেখান থেকে সে আর ফিরবে না।
আফিয়ার মা নুসরাত জাহান গতকাল শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মা দিবসে কার্ডে ছবিটা এভাবে কেন এঁকেছিল আফিয়া, তা আগে তেমন করে ভাবেননি তিনি। ডায়েরিতে ভ্রমণের কথাসহ যে ছবি সে এঁকেছে, তা আগে তিনি সেভাবে খেয়াল করেননি। আফিয়ার চলে যাওয়ার পর দেখেছেন তিনি।
বড় বড় চোখ করে মায়ের বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ের হাসিমুখের একটি ছবি এই প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছেন নুসরাত। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এটা আমাদের মা-মেয়ের শেষ অন্তরঙ্গ ছবি। আর কোনো ছবি তোলা হবে না এইভাবে।’
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার (ইংরেজি ভার্সন) তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আফিয়া। কোনো কিছুতেই তার স্কুলে যাওয়া আটকানো যেত না।
নুসরাত বলেন, ৫ আগস্ট সকালে নাশতার টেবিলে বসে গল্প করতে করতে আফিয়া জানিয়েছিল, একটি মশা তাকে কামড়েছে। খুব সম্ভবত স্কুলে থাকা অবস্থায়ই তাকে কামড়েছে মশা।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে স্কুল খোলা রাখার সরকারি সিদ্ধান্তে নুসরাত বিরক্ত ছিলেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মেয়েকে স্কুলে না যেতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়ে স্কুল কামাই করতে চায়নি। তাই বাধ্য হয়েই মেয়েকে স্কুলে পাঠাতেন বলে জানান নুসরাত।
৫ আগস্ট সকালে খাবার টেবিলে বসে দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে মেয়েকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছিলেন নুসরাত। এই খাবার টেবিলে বসেই তিনি খবর পেয়েছিলেন যে অন্য একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তাঁর এক সহকর্মীর মেয়ে ডেঙ্গুতে মারা গেছে।
৫ আগস্ট দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে হতে আফিয়ার চোখ লাল হয়ে যায়। তার শরীরব্যথা শুরু হয়। রাতে জ্বর ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে। ঘরে থাকা সাপোজিটর দিয়ে, সারা শরীর মুছিয়ে দিয়ে জ্বর কমানোর চেষ্টা করেন নুসরাত।
গতকাল রাতে মুঠোফোন নুসরাত ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নির্বাচনের কথা চিন্তা করে এই সময় স্কুল খোলা রাখার ঘোষণা দেওয়া হলো। স্কুল খোলা না থাকলে হয়তো মেয়েটাকে মশা কামড়াতে পারত না। স্কুলগুলো ডেঙ্গু প্রতিরোধে তেমন কোনো কার্যক্রম চালু করেনি। মেয়ের স্কুলের আরও দুই শিশু ডেঙ্গুতে মারা গেছে। হাসপাতালে খারাপ অবস্থায় দুটি শিশু ভর্তি আছে বলে শুনেছি। আমার মেয়েটা মারা যাওয়ার পর স্কুল থেকে আজ পর্যন্ত কেউ একবার খোঁজ নেয়নি। অথচ স্কুলের কাছেই আমার বাসা।’
প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠকের মতামত জানতে অনলাইন ভোটের আয়োজন করা হয়। ১০ আগস্ট অনলাইন ভোটের বিষয় ছিল—নির্বাচনের কারণে ডেঙ্গু ইস্যুটি পেছনে পড়ে গেছে, তাতে দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়েছে—স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক সানিয়া তাহমিনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত? ভোটে ৯২ শতাংশ পাঠক ‘হ্যাঁ’-সূচক উত্তর দিয়েছেন।
আফিয়ার মা নুসরাত রাজধানীর মতিঝিলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত। আফিয়ার বাবা আবুল কালাম আজাদ অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত। তিনি আগে ঢাকায় ছিলেন। মাসখানেক আগে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়ে পটুয়াখালীর দশমিনা শাখায় যান। আফিয়ার যখন জ্বর আসে, তখন তিনি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। পরের দিন তিনি ঢাকায় আসেন।
ডেঙ্গুর পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন নুসরাত। কাঁদতে কাঁদতে নুসরাত বলেন, মেয়ের জ্বরের পরদিনই (রোববার) ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য তাকে সিদ্ধেশ্বরীর মনোয়ারা হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে নিয়ে যান। ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা নিয়ে মেয়েকে ভর্তি না করে কিছু ওষুধের নাম লিখে দেন চিকিৎসক। আর জানিয়ে দেওয়া হলো, পরীক্ষার ফলাফল জানা যাবে সোমবার রাত আটটার পর। পরীক্ষার প্রতিবেদনটা আগে দেওয়া যায় কি না, তার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল।
পরদিন রাতে মেয়ের বাবা যখন রিপোর্ট আনতে যান, তখন নানা টালবাহানা করতে থাকেন সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বলতে থাকেন, শিশু তো, তাই পরীক্ষার ফলাফল বোঝা যাচ্ছে না। তবে একসময় স্বীকার করেন, তাঁরা মেয়ের রক্তের নমুনা হারিয়ে ফেলেছেন। অথচ, এই কথা আগে জানাননি। পরে পরীক্ষার টাকাও ফেরত দেন তাঁরা। জ্বরের পর থেকে মেয়েটাকে বাঁচাতে পরিবারের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য মেয়েটাও ১০টা দিন অনেক সংগ্রাম করল। কিন্তু মনোয়ারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুটো দিন নষ্ট করে দিল।
নুসরাত তাঁর অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে মনোয়ারা হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ও ডেঙ্গু পরীক্ষার রশিদের কপি প্রথম আলোকে পাঠিয়েছেন। রশিদের নিচের দিকে লেখা রয়েছে ‘স্যাম্পল ক্লট’। অর্থাৎ, রক্তের নমুনা জমাট বেঁধে গেছে। এই নমুনা আর পরীক্ষার উপযোগী নেই।
‘স্যাম্পল ক্লট’ যিনি লিখেছেন, তাঁর নাম (তাহের) ও ফোন নম্বর রশিদে উল্লেখ রয়েছে। এই ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে জানা যায়, তাঁর পুরো নাম মো. তাহের। তিনি নিজেকে ল্যাব ম্যানেজার বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, নমুনাটি হারিয়ে যায়নি, ক্লট হয়ে গিয়েছিল। নমুনা কেন ক্লট হয়ে গিয়েছিল, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। পরে তাঁরা নতুন করে নমুনা দিতে বলেছিলেন। তবে রোগীর স্বজনেরা তখন আর রাজি হননি। তাঁরা টাকা ফেরত নেন।
হাসপাতালটির পরিচালক মেহজাবিন ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ হাজারে হয়তো একটি রক্তের নমুনা ক্লট হয়ে যায়। অনেক কারণে এমনটা হতে পারে। শিশুটির ক্ষেত্রে যেটা (ক্লট) হয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা নতুন করে নমুনা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তাঁরা (রোগীর অভিভাবক) রাজি হয়নি।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে নুসরাত বলেন, ‘ওই মুহূর্তে বা এখনো আমাদের সেই পরিস্থিতি নেই। মেয়েটাই তো চলে গেছে। ব্যবস্থা নিয়ে কী হবে?’
নুসরাত বলেন, মনোয়ারা হাসপাতালে আর সময় নষ্ট না করে বাসার কাছের আরেকটি হাসপাতালে মেয়ের ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হলে পজিটিভ আসে। আফিয়াকে ছোটবেলা থেকে যে চিকিৎসক দেখতেন, তিনিও পরীক্ষার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মেয়ের ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
নুসরাত জানান, ‘মঙ্গলবার মেয়েকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। আমার মেয়েটার অনেক ধৈর্য ছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, অথচ চিৎকার করে কান্না করেনি। শেষের দিকে মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকায় সে কথা বলতে পারত না। তখন সে বাবার মুঠোফোন থেকে তার কষ্ট হচ্ছে কি না, পায়খানা হলো কি না, মুখের মাস্ক কেন খুলে দিচ্ছে না, এগুলো লিখে জানাত। আমি মেয়ের পাশে একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন দুই চোখ আর খোলা রাখতে পারছিলাম না, তখন মেয়ে নিজেই তার পাশে শোবার জন্য জায়গা করে আমাকে ইশারা করত। নিজে স্কুল থেকে ফিরে বাসার কাছের আরেকটি স্কুল থেকে ছোট বোনকে আনত আফিয়া। ছোট মেয়েটা এখনো জানে না যে তার বড় বোন তাকে আর স্কুল থেকে আনতে যাবে না। সে শুধু জানে, বড় বোন এখনো হাসপাতালে আছে।’
নুসরাত বলেন, মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর তার চিকিৎসা ঠিকভাবেই হয়েছিল বলে মনে করেন তাঁরা। তবে হাসপাতালে ভর্তির আগে দুটো দিন নষ্ট হয়ে গেছে। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে মেয়ে মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলে বলেছিল, তার খিদে লেগেছে। কিছু খেতে দিতে বলেছিল সে। তারপরই চিকিৎসকেরা আবার মাস্ক পরিয়ে দিয়েছিলেন।
নুসরাত বলেন, ‘মেয়েকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পর আমি ওর মাথায় হাত রাখলেই ও বুঝতে পারত, মা কাছে এসেছে। তখন ও অস্থির হয়ে যেত। তাই নার্স ও চিকিৎসকেরা আমাকে মেয়ের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তো সব শেষ।’
আফিয়া ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসত। কিডস টাইম নামের একটি অনলাইন স্কুলে সে আঁকা-আঁকি শিখত। নুসরাত বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর আফিয়া বায়না ধরেছিল, সে অনলাইনে ড্রয়িং পরীক্ষা দেবে। হাসপাতালে খাতা, রং, পেনসিল নেই এসব বলে তাকে শান্ত করেছিলেন তিনি।
নুসরাত বলেন, ‘আমার মেয়েটা হীরার টুকরা ছিল। কোনো দিন জেদ করেনি। তেমন কোনো বায়না ছিল না তার। হাসপাতালে ওর অবস্থা তখন খুব খারাপ, তার মধ্যও সে খেয়াল করে, আমার হাতে ঘড়ি এবং চোখে চশমা নেই। ইশারায় এগুলো নেই কেন, তা জানতে চেয়েছিল। তখন ব্যাগ খুলে দেখাই, এগুলো আমার সঙ্গেই আছে।’
১৩ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘এ বছর ডেঙ্গুতে ৭১ শিশুর মৃত্যু’। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ডেঙ্গুতে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের কম।
প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনে ডেঙ্গুতে শিশুদের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত।...শিশুদের আমরা নতুন বিপদে ঠেলে দিলাম।’
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ আগস্ট। আফিয়া অজানা ভ্রমণে বের হয় ১৪ আগস্ট। এরপর আফিয়ার মতো এমন ভ্রমণে বের হওয়া শিশুর তালিকায় আরও নাম যুক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও নাম যুক্ত হবে। সন্তান হারানো মা নুসরাত, বাবা আবুল কালামের আহাজারি চলতে থাকবে। হারানো সন্তানের স্মৃতি হাতড়েই তাঁদের পার করতে হবে বাকি জীবন।
গতকাল দিবাগত রাত দুইটার সময় নুসরাত যখন এই প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর মেয়ের আঁকা একাধিক ছবি, ডায়েরির লেখা পাঠাচ্ছিলেন, তখন এই মায়ের মনের ভেতর যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, তার আঁচ স্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছিল।
মেয়ে বড় হয়ে কী হবে, এমন কিছু বলত কি না, জানতে চাইলে নুসরাত বলেন, ‘মেয়েকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, এমন চাপ আমরা কখনোই দিইনি। ভালো ও মন্দের পার্থক্যটা শেখাতাম। ও নিজেও কখনো ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, এমন কথা বলেনি। ড্রয়িংয়ের পাশাপাশি ক্রাফটিং করতে পছন্দ করত। সময়ের হাতে সব ছেড়ে দিয়েছিলাম।’