জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শালবনে বনখেজুরের গাছ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শালবনে বনখেজুরের গাছ

বিপন্ন বনখেজুর

রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্মের এক দুপুরে টাঙ্গাইলের সখীপুরে এক শালবনে ঘুরছি। নবীন কচি পাতায় শালগাছগুলো মোহনীয় হয়ে উঠেছে। নিচে তখনো জমে আছে শুকনো পাতা। হাঁটতে গেলে মচমচ করে শব্দ হয়। সে শব্দ ঝিঁঝি পোকাদের সঙ্গে মিলেমিশে সংগীতের মূর্ছনা সৃষ্টি করছে। মাঝেমধ্যে দু-একটা পাখির ওড়াউড়ি আর ডানা ঝাপটানোর শব্দ। একটা গাছের খোঁজে গিয়েছি শালবনে। বিশাল পাতার বনচালতার চারা, ঝোপঝাড় পেঁচিয়ে ওঠা লতা ঢেঁকিয়া আর আলকুশির লতা, খামচি দিয়ে জামা টেনে ধরা আনই আর শিয়াকুলের কণ্টকময় ডাল—এসব উপেক্ষা করে চোখ চাইছে একটা গাছের দেখা পেতে।

কিন্তু তার দেখা নেই। দেখা না পাওয়ারই কথা। আগেই জানা ছিল, গাছটা বিপন্ন, এর আগে কোথাও দেখিনি। সঙ্গে থাকা সখীপুরের যাদবপুর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব আফসার উদ্দিনের কথার লোভে পড়ে এই ভরদুপুরে শালবনে ঘুরছি। তিনি বলেছিলেন, এই বনে নাকি তিনি বনখেজুরের গাছ গত বছরও দেখেছেন। ছোটবেলায় এই বনে ঘুরে ঘুরে গ্রীষ্মকালে বনখেজুরের পাকা ফল তুলে তুলে খেতেন। কিন্তু এখন আর সেভাবে সহজে এ গাছের দেখা মেলে না।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আফসার দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ওই দেখেন একটা বনখেজুরের চারা। চারা মানে ধারেকাছে কোথাও নিশ্চয়ই বনখেজুরের মা গাছ আছে। খুঁজতে লাগলাম। চারাটি যে বনখেজুরের, তা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? আফসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, বনখেজুরগাছের কখনো আপনি মাটির ওপরে অন্য খেজুরগাছের মতো গুঁড়ি দেখতে পাবেন না, তা ছাড়া খেজুরের মতো এর পাতাগুলো ধনুকের মতো বাঁকা হয় না, সোজা ও খাড়া থাকে, অনেকটা ঝাঁটার মতো।

কথার সঙ্গে বৈশিষ্ট্য মিলে গেল। কিন্তু অনেকটা হাঁটাহাঁটির পর ওই চারাটা দেখেই মনের দুঃখ নিয়ে ফিরতে হলো; কোথাও ওই শিশু বনখেজুরের মা-বাবা অথবা ফলের দেখা পেলাম না। দুঃখের কথাটা জানিয়ে দিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের উদ্ভিদ গবেষক আব্দুর রহিমকে। তিনিও নিশ্চিত করলেন, বনখেজুর এ দেশে বিরল ও বিপন্ন উদ্ভিদ।

এক বছর পর এবার অবশেষে তিনিই এবার গ্রীষ্মে খবর দিলেন, ফল ধরা বনখেজুর দেখতে হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন, ফুল-ফল ধরেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম সেখানে। সেখানকার ‘সুন্দরবন’খ্যাত বনটার ভেতরে এক টুকরো শালবন আছে। সেখানে সংরক্ষিত বন হলেও তা এখন একেবারেই অরক্ষিত। এর মধ্যেই তিনি প্রথমে দেখালেন বনখেজুরের একটি স্ত্রী গাছ। পাতাগুলো ঊর্ধ্বমুখী, মাটির ওপরে কাণ্ড প্রায় নেই, পাতাগুলো প্রায় ভূসংলগ্ন কাণ্ড থেকে বেরিয়ে তেরছাভাবে খাড়া হয়ে আছে আর পাতাগুলোর কোল থেকে খাটো ঊর্ধ্বমুখী ছড়ায় ধরে আছে চিনাবাদামের দানার আকারের ছোট ছোট খেজুর। বেশি দূরে যেতে হলো না, পেয়ে গেলাম আর একটা পুরুষ বনখেজুর গাছের দেখা। সেখানে পুষ্পমঞ্জরি বা কাঁদি আছে, অসংখ্য ঘিয়া সাদা ফুলে ভরা, হাত দিলে ঝাঁকা দিলে সাদা পাউডারের মতো পরাগরেণু উড়ছে সে গাছ থেকে। রহিম ভাই জানালেন, এসব রেণু বাতাসে উড়ে গিয়ে মেয়ে গাছটার ফুলে পড়ে ও পরাগায়ন হয়। এরপর হয় খেজুর। দীর্ঘ এক বছরের অপেক্ষার অবসান হলো বনখেজুরের জন্য।

খেজুরগাছ অ্যারিকেসি পরিবারের ফিনিক্স (Phoenix) মহাজাতি বা গণভুক্ত। এ গণের ১৪টি প্রজাতির গাছ সারা পৃথিবীতে রয়েছে। এর মধ্যে এ দেশে আছে পাঁচটি প্রজাতির খেজুরগাছ। খুদি খেজুর, ভূখেজুর বা বনখেজুর Phoenix acaulis প্রজাতির। বনখেজুরগাছ একবীজপত্রী, একলিঙ্গবিশিষ্ট বৃক্ষ। অর্থাৎ পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদা। স্ত্রী গাছে ফল ধরে। শাখাহীন গাছ লম্বা হয় ২-৩ মিটার। গাছের বাকলসদৃশ আবরণে পত্রবৃন্তের দাগ সব কাণ্ডকে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সে কাণ্ড থাকে মাটির নিচে, গাছ বড় হলে তার কাণ্ড মাটির ওপরে অল্প কিছুটা দেখা যায়। পাতা পক্ষল, পত্রদণ্ডের দুই দিকেই হয়, অগ্রভাগ সুচালো, গোড়ায় তীক্ষ্ণ শক্ত কাঁটা। গাছের মাথায় পত্রগুচ্ছ নারিকেল-সুপারিগাছের মতো জন্মে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে ফুল ফোটে। কাঁদিতে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটে।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক