শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসনের রোডম্যাপ নিয়ে প্রেস ব্রিফিং. বিএসএল ভবন, শাহবাগ
শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসনের রোডম্যাপ নিয়ে  প্রেস ব্রিফিং. বিএসএল ভবন, শাহবাগ

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন

আন্দোলনে আহতদের প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে, খরচ দেবে সরকার

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের জন্য সরকারি হাসপাতালে সম্ভব না হলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হবে। দেশে চিকিৎসা সম্ভব না হলে পাঠানো হবে বিদেশে। এই চিকিৎসার সব ধরনের খরচ বহন করবে সরকার। এর বাইরে তাঁদের নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া হবে। আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য হবে নীতিমালা।

আজ বৃহস্পতিবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেলের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের রোডম্যাপ সম্পর্কে জানাতে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসংলগ্ন বিএসএল ভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, এর আগে শহীদ ও আহতদের একটি তালিকা করা হয়েছে। এই তথ্যগুলো এমনভাবে যাচাই করা হচ্ছে, যাতে ২০ বছর পরও এই তালিকা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। নভেম্বরের মধ্যে শহীদ পরিবারের তথ্যগুলো যাচাই শেষ করা এবং ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।

আহতদের জন্য ‘ইউনিক আইডি কার্ড’ করা হবে বলেও জানিয়েছেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ক্যাটাগরি (ধরন) অনুযায়ী কার্ডগুলো ভিন্ন থাকবে। প্রতিটি ক্যাটাগরির জন্য সুযোগ-সুবিধাও ভিন্ন থাকবে। অগ্রাধিকার নির্ধারণের জন্যই এটি করা হবে।

আহতদের চিকিৎসায় অগ্রাধিকার

সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত সবাইকে সরকারি হাসপাতালগুলোয় ‘ফার্স্ট ট্র্যাক সার্ভিস’ দেওয়া হবে। সারা দেশের হাসপাতালগুলোকে এই নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। আহতরা সরকারি হাসপাতালে আজীবন সব ধরনের চিকিৎসা বিনা মূল্যে পাবেন। এমনকি যে চিকিৎসাসেবাগুলো সরকারি হাসপাতালে নেই, সেগুলো তাঁরা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিলেও সরকার তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী মূল্য পরিশোধ করবে।

সায়েদুর রহমান আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএইউ) কেবিন ব্লক আহতদের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড (নিয়োজিত) করা হয়েছে। ৪৪টি কেবিনে ৮৮টি বেড ডেডিকেটেড থাকবে। পর্যায়ক্রমে সেখানে ফিজিওথেরাপি সেবাগুলো যুক্ত করা হবে। রোবোটিক অত্যাধুনিক ফিজিওথেরাপি সেবা স্থাপনের জন্যও সরকার চেষ্টা করছে। এই সেবার জন্য প্রয়োজনে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ দল এনে প্রথম পর্যায়ে এই সেবা শুরু করা হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রোগীর চাপ বাড়লে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালকেও ডেডিকেট করা হবে। সেখানে একটি তলায় ২০০ বেড স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি, এটি পাঁচ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। এ ছাড়া বিভাগীয় হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো একই ছাতার নিচে থাকবে।’

আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সায়েদুর রহমান বলেন, ‘তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরির অন্যতম কারণ মানসিক ট্রমা (আঘাত)। এই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এ পর্যন্ত খুব ভালোভাবে দেখা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি না। আমরা স্বীকার করছি, এই বিষয়টি আমরা যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে পেরে উঠিনি। এ জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের পাশাপাশি দেশের সরকারি-বেসরকারি যাঁরা এই সেবার সঙ্গে আছেন, তাঁদের যুক্ত করে একটি নেটওয়ার্ক করা হবে।’

প্রয়োজনে নেওয়া হবে বিদেশে

আহত ব্যক্তিদের প্রয়োজনে বিদেশে নেওয়া হবে উল্লেখ করে মো. সায়েদুর রহমান বলেন, আহতদের বিদেশ পাঠিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে চাপ আছে। যাঁর প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে দ্রুততম সময়ে তাঁদের সেই চিকিৎসা দেওয়ার। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাঁদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। আজও একজন যাবেন। গতকালও একজন গেছেন। যখনই যাঁর প্রয়োজন, সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে হাসপাতাল থেকে আসা সুপারিশের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশের ভিত্তিতে তাঁদের পাঠানো হচ্ছে।

চোখে গুলিবিদ্ধদের বিষয়ে সায়েদুর রহমান বলেন, এবারের অভ্যুত্থানে যাঁরা আহত হয়েছেন, পৃথিবীতে এই ধরনের আহতের সংখ্যা দুই থেকে তিনবার ঘটেছে। সে জন্য চোখের ‘গানশট ইনজুরিতে’ পৃথিবীতে যাঁরা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁদের দেশে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি সম্ভব না হলে সুনির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোতে তাঁদের পাঠানো হচ্ছে।

আইনি বন্দোবস্ত

গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে মামলাগুলোর বিষয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘শহীদ পরিবারকে ব্যবহার করে পুরো বাংলাদেশে মামলার একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে। কিছু মামলা সঠিকভাবেই হচ্ছে। কিছু এমন হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিবর্গ শহীদ পরিবারকে কিছুটা বাধ্য করে কিংবা বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করে তাদের দিয়ে মামলা দেওয়ানোর ব্যবস্থা করছেন। কিছু ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন দেখা যাচ্ছে, মামলায় এমন কিছু ব্যক্তিকে দেওয়া হচ্ছে, যাঁদের ওই ব্যক্তির শহীদ হওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই।’

শহীদ পরিবারের উদ্দেশে সারজিস বলেন, ‘অনুগ্রহ করে কারও প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যেন কোনো মামলা না হয়। তাঁদের যদি মামলাসংক্রান্ত যেকোনো ধরনের আইনি সহায়তার প্রয়োজন হয়, আমরা সার্বিকভাবে তাঁকে সহযোগিতা করব। আমরা চাই দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হোক, কিন্তু নির্দোষ ব্যক্তি যেন কোনো হয়রানির শিকার না হন, তাঁর যেন কোনো শাস্তি না হয়।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সমন্বয়ক বলেন, ‘এমনও যদি হয় কোনো শহীদ বা আহত পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, চাপ প্রয়োগকারী সেই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করা হয়, তাহলে আমরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও সহযোগিতা করব।’

অর্থসহায়তা দেওয়া হবে যেভাবে

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ) বলেন, ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শহীদদের এককালীন পাঁচ লাখ টাকা এবং আহতদের এককালীন এক লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছিল। আহতদের জন্য এই টাকার পরিমাণ এখন এক লাখ থেকে তিন লাখ করা হয়েছে। আহত হওয়ার মাত্রা অনুযায়ী এটি দেওয়া হচ্ছে।

মীর মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘অনেকে চিকিৎসার জন্য নিজেদের টাকা খরচ করেছেন। তাঁদের এখন পর্যন্ত যত টাকা খরচ হয়েছে, সেগুলো ফেরত দেওয়ার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তিন লাখ টাকার বাইরে এই অর্থ দেওয়া হবে। আহতরা এখন পর্যন্ত যে খরচ করেছেন, সেগুলো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আমাদের সেলে জমা দিলে যাচাই করে পুরো টাকাটি জমা দেব।’

অর্থসহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সারজিস আলম বলেন, আহতদের ফাউন্ডেশনের অর্থসহায়তা নেওয়ার জন্য চারটি কাগজ লাগবে। প্রথমত, ফাউন্ডেশনের একটি ফরম লাগবে। এটি পূরণ করে চিকিৎসকের দ্বারা সত্যায়িত করতে হবে। তিনি যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বা ছাড়পত্র পেয়েছেন, সেই হাসপাতালের কাগজগুলো সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের দিয়ে সিলসহ স্বাক্ষর করিয়ে নিতে হবে। ক্ষতস্থানের একটি ছবি দিতে হবে। এর সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মসনদ দিতে হবে। এগুলো ফাউন্ডেশনে জমা দিতে হবে।

আর নিহতদের জন্য মৃত্যুসনদ অথবা স্থানীয় কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে বলে জানান সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘ওই প্রত্যয়নপত্রে লেখা থাকবে—তিনি যে এলাকার বাসিন্দা, যেখানে শহীদ হয়েছেন এবং যেখানে দাফন করা হয়েছে। এর সঙ্গে শহীদের পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ দিতে হবে। পাশাপাশি যিনি নমিনি হবেন তাঁর পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ আমাদের এখানে জমা দিতে হবে।’

পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানে হবে নীতিমালা

আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেলের টিম লিডার অতিরিক্ত সচিব খন্দকার জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা আহত হয়েছেন বা শারীরিকভাবে এমন অবস্থায় আছেন যে আদৌ কাজকর্মে ফিরতে পারবেন না বা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন না। তাঁদের জন্য সরকার কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে, যেগুলোর মাধ্যমে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

শহীদ পরিবারের বিষয়ে জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারের কাউকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা সরকারের আছে। এ ছাড়া যাঁরা আহত হয়েছেন, কোনো কাজ করতে পারবেন না, তাঁদের পরিবারের একজনকে অথবা একাধিক ব্যক্তিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। যাঁরা আহত বা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্তও সরকার গ্রহণ করেছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে সরকার এগুলো বাস্তবায়ন করবে।’