চিপস, কৃত্রিম পানীয়ের মতো অস্বাস্থ্যকর খাবার খায় ৫০% শিশু

জরিপে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের খাদ্যাভ্যাসের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।

ওরা যমজ ভাই। থাকে রংপুরে। বয়স প্রায় চার। ওদের বয়স যখন আরও কম ছিল, তখন থেকেই চিপস, চকলেট ও নানা ধরনের কৃত্রিম পানীয়ের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। এখন অবস্থা এমন যে সকালবেলায় সাধারণ খাদ্যের বদলে অনেক সময় ওদের দিতে হয় এসব খাবার। শিশু দুটির মা বলছিলেন, তাঁর দুই সন্তানকে এসব খাবার থেকে কোনোভাবেই দূরে রাখতে পারছেন না।

শিশুর জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ তার জন্য প্রধান খাদ্য। ছয় মাস বয়স হওয়ার পর শিশুকে বাড়িতে তৈরি সুষম, পুষ্টিকর খাওয়ার দেওয়ার কথা বলেন পুষ্টিবিদ ও শিশুবিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২–এ দেখা যাচ্ছে, ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু কোমল পানীয়, অতিরিক্ত লবণ ও চিনিসমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছে।

জরিপেই এসব খাবারকে অস্বাস্থ্যকর বলা হয়েছে। চিকিৎসাবিদ, পুষ্টিবিদ ও গবেষকদেরও মতামত তাই। তাঁদের কথা, পরিস্থিতিটি ভয়াবহ। কারণ, এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার শিশুদের স্থূলকায় করে তোলে এবং নানা রোগের কারণ হয়।

পাঁচটি ‘চ’ আদ্যক্ষরের খাবার এখন শিশুদের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠছে—চিপস, চানাচুর, চকলেট, চুইংগাম ও চাটনি। প্রতিটি সুষম খাবারের পরিপন্থী।
অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা, শিশুবিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ প্রকাশিত হয় গত মাসে, অর্থাৎ এপ্রিলে। জরিপটি করেছে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। জরিপে দেশের ৩০ হাজার ৩৭৫টি পরিবারের কাছ থেকে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। খাদ্য গ্রহণসংক্রান্ত তথ্য নেওয়া হয় ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী ২ হাজার ৫৭৮টি শিশুর।

জরিপে উঠে আসে, ৩২ শতাংশ শিশু তথ্য সংগ্রহের আগের দিন কোমল পানীয় পান করেছে। ৪৯ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত চিনি ও লবণজাতীয় অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছে।

নিপোর্টের পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ আহছানুল আলম গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, কোমল পানীয় বলতে নানা ধরনের ‘কার্বোনেটেড’ পানীয়, প্রক্রিয়াজাত ফলের রসকে বোঝানো হয়েছে। আর অতিরিক্ত লবণ ও চিনিজাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে চিপস, চানাচুর, আধা প্রস্তুতকৃত (ইনস্ট্যান্ট) নুডলস এবং বার্গারসহ নানা ‘জাংক ফুড’।

নিপোর্টের প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সংজ্ঞা ব্যবহার করে এসব খাবারকে অস্বাস্থ্যকর বলা হয়েছে। কারণ, এসব খাবারে মাত্রাতিরিক্ত লবণ, চিনি ও চর্বি থাকে।

গরমে পানিশূন্যতা রোধে শিশুকে পান করতে হবে পর্যাপ্ত পানীয়। মডেল: আয়াজ ও মীম

জরিপে কেন ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের তথ্য নেওয়া হলো জানতে চাইলে আহছানুল আলম বলেন, ‘ছয় মাস বয়স থেকেই শিশুকে স্বাভাবিক খাবার দেওয়ার কথা। সে সময় এসব খাবারের বদলে আসলে কী দেওয়া হচ্ছে, তা জানতেই জরিপে এই বয়সী শিশুদের বেছে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্থূল জন্মহার, স্থূল মৃত্যুহার ও জনসংখ্যার তথ্য বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৪৭ লাখ।

নিপোর্টের জরিপের হার বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, ২৩ লাখের বেশি শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছে।

এসব খাবারে কী থাকে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে শিশুরা যেসব কৃত্রিম পানীয় পান করে, সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও সংরক্ষক (প্রিজারভেটিভ) থাকে। সংরক্ষক ও সুইটেনিং এজেন্টে (মিষ্টিকারক) আবার নানা ধরনের ক্ষতিকর উপাদান থাকে, যা শিশুর অস্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধির কারণ হয়।

চিপস, বার্গার ও আধা প্রস্তুত করা নুডলসে সাধারণ লবণ বেশি ব্যবহার করা হয়। অল্প বয়সে মাত্রাতিরিক্ত লবণে ভরা খাবার শিশুর শরীরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে বলে জানান অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার। তিনি আরও বলেন, শিশুদের শরীরে অতিরিক্ত লবণ গেলে তা তাদের উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে, যেটা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যেসব শিশু এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বড় হয়, তারা পরিণত বয়সে ডায়াবেটিসসহ নানা রোগের ঝুঁকিতে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোটকালের খাদ্যাভ্যাসের কারণে বড়কালের রোগকে এভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এত শিশু। এটা ভয়ানক।

যেসব মা–বাবা এই বিপদ সম্পর্কে জানেন, তাঁরা সন্তানকে এসব খাবার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও বললেন এক অভিভাবক। যেমন রাজধানীর উত্তরার সাজেদুল ইসলামের (ছদ্মনাম) তৃতীয় সন্তানের বয়স দুই বছর। সাজেদুল বলছিলেন, ‘বাড়ির বাইরে গেলেই জোর করে দোকানে নিয়ে যায় ছেলে। ওর যন্ত্রণায় কোমল পানীয় লুকিয়ে ফ্রিজে রেখে দিই। সেখান থেকে বের করে খায় ছেলে। আর চিপস বা চানাচুরজাতীয় খাবার পেলে তো কথাই নেই।’

পাঁচ ‘চ’–এ ‘বিপদ’

শিশুর জন্মের পর প্রথম তিন বছর শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে তার মানসিক বিকাশ বেশি হয় বলে গবেষকেরা বলে থাকেন। এর জন্য চাই সুষম খাবার।

নিজের অভিজ্ঞতায় শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলছিলেন, পাঁচটি ‘চ’ আদ্যক্ষরের খাবার এখন শিশুদের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠছে—চিপস, চানাচুর, চকলেট, চুইংগাম ও চাটনি। প্রতিটি সুষম খাবারের পরিপন্থী। এগুলো খেলে ক্ষুধা নষ্ট হয়।

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে তিনটি বড় সমস্যা শিশুদের মধ্যে দেখতে পান বলে জানান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা। যার প্রথমটি হলো আয়রনের ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ভিটামিন ডির ঘাটতি। এই চিকিৎসক বলেন, দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশু সুষম খাবারের অভাবে রক্তস্বল্পতায় ভোগে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এটি এখন সচ্ছল পরিবারের শিশুদের আক্রান্ত করছে।

শিশুরা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলে বলে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে না। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য ও ভিটামিনের ঘাটতি হয় বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা। তিনি বলেন, সন্তানকে এসব খাবার থেকে দূরে রাখতে মা–বাবাকে সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে প্রচার দরকার।