রোকাইয়া বিনতে রায়হান আর রুফাইদা বিনতে রায়হান যমজ বোন। বয়স পাঁচ বছর। আর রুবাইয়া বিনতে রায়হানের বয়স মাত্র আট মাস। দিনে তিন বোন সবার আদরে হাসিখুশি থাকে, রাতে শুরু হয় কান্না। রুবাইয়া মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য কাঁদে আর রোকাইয়া ও রুফাইদা মাকে ফোন দিতে, তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলে। তিন শিশুর নানি হাসি বেগম রাতে ঘুমাতে পারেন না। তিনিও নাতনিদের নিয়ে একরকম কেঁদেই রাত পার করেন।
৭ আগস্টের পর থেকে এই নানি ও নাতনিদের রুটিন এটাই হয়ে গেছে। ওই দিন হাসি বেগম হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে আয়শা আক্তার তানিশাকে (২৪) আর ছোট তিন মেয়ে তাদের মাকে।
হাসি বেগম অভিযোগ করে বলেন, আয়শা ছিল খুব চাপা স্বভাবের। বেশির ভাগ সময় স্বামীর নির্যাতনের কথা গোপন রাখতেন। নির্যাতন ও টাকার জন্য স্বামীর চাপ দেওয়া নিয়ে আগে পারিবারিকভাবে সালিসও হয়েছে।
আয়শার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা দাবি করছেন, আয়শা আত্মহত্যা করেছেন। আর হাসি বেগম বলছেন, তাঁর মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।
আয়শার মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ২৩ আগস্ট সংঘবদ্ধভাবে খুনের অভিযোগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (ওয়ারি) আদালতে আয়শার স্বামী, মাসহ অন্যদের আসামি করে সি আর মামলা (পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারা) করেন আয়শার বড় ভাই ওসমান গনি। তিন মেয়ে জন্ম দেওয়ায় আয়শাকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় ৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মর্গের সুরতহাল প্রতিবেদন বলছে, আয়শার হাতের বিভিন্ন স্থানে লালচে দাগ, গলায় চন্দ্রাকার কালো দাগ ছিল।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বংশালে নিজের বাসায় বসে হাসি বেগম বললেন, ‘আমার কথা চিন্তা করে আর নিজের তিন মেয়েকে রেখে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতেই পারে না। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কে কে মেরেছে, কীভাবে মেরেছে তা আমি জানি না। আমি শুধু আমার মেয়ে হত্যার ন্যায্য বিচার চাই।’
মঙ্গলবার দুপুরে গোয়ালঘাট লেনে আয়শার শ্বশুরবাড়ির এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে হাসি বেগম, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় ঝুলছে বড় ব্যানার।
৭ আগস্ট ওয়ারী থানার ৩৮ নম্বর গোয়ালঘাট লেনের বাসায় আয়শার মরদেহ পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানিয়েছেন, ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আয়শা আত্মহত্যা করেছেন। তবে আয়শার বাসার কাজে সাহায্যকারী শাহানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, আয়শাকে ফ্যান থেকে যখন নিচে নামানো হয়, তখন তাঁর দুহাত পেছনে বাঁধা ছিল। এর আগে আয়শা তিন মেয়েকে সঙ্গে দিয়ে শাহানাকে শ্বশুরের বাসায় পাঠিয়ে দেন। ঘণ্টাখানেক পর ফিরে দরজায় কলিং বেল চাপলে কারও সাড়া পাওয়া যায় না। পরে আয়শার স্বামী ছাদ থেকে নেমে একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়।
আয়শার শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো। নিজেদের বাড়ির চারতলায় আয়শা স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। এ বাড়িতেই বিভিন্ন তলায় তাঁর শ্বশুর, শাশুড়িসহ অন্যরা থাকেন। ৭ আগস্টের পর বাড়ির সদস্যরা পালিয়ে গেছেন। সবার মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ। তবে এলাকাবাসী বলছেন, রাতে তাঁরা বাড়িতে এসে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যান। আর আয়শার মেয়েরা হাসি বেগমের সঙ্গে থাকছে।
মঙ্গলবার দুপুরে গোয়ালঘাট লেনে আয়শার শ্বশুরবাড়ির এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে হাসি বেগম, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় ঝুলছে বড় ব্যানার। মানববন্ধন শেষে হাসি বেগম নিজের বাসায় গিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন।
আয়শার বাসার কাজে সাহায্যকারী শাহানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, আয়শাকে ফ্যান থেকে যখন নিচে নামানো হয়, তখন তাঁর দুহাত পেছনে বাঁধা ছিল। এর আগে আয়শা তিন মেয়েকে সঙ্গে দিয়ে শাহানাকে শ্বশুরের বাসায় পাঠিয়ে দেন। ঘণ্টাখানেক পর ফিরে দরজায় কলিং বেল চাপলে কারও সাড়া পাওয়া যায় না। পরে আয়শার স্বামী ছাদ থেকে নেমে একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়।
২০১৮ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় আয়শার। স্বামীর নাম মো. শেখ রায়হান পরশ। আয়শার পরিবারের অভিযোগ, রায়হান জুয়া, অনলাইন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। নিজের পরিবার থেকে যে টাকা পেতেন, তা দিয়ে চলত না তাঁর। তাই প্রায় সময়ই বিভিন্ন অজুহাতে টাকা চাইতেন আয়শার মা ও ভাইয়ের কাছে। ৭ আগস্টও তিনি আয়শার মুঠোফোন থেকে ফোন করে আয়শার ভাই ওসমান গনির কাছে টাকা চান। এ সময় স্বামীর পাশ থেকে আয়শা জোরে জোরে ভাই যাতে আর টাকা না দেন সে কথা বলতে থাকেন। পরে শাহানার ফোন থেকে আয়শা মাকেও ফোন করে আর যেন টাকা না দেওয়া হয়, সে কথা জানান।
আমাদের দুই ভাইয়ের একটাই বোন ছিল। খুব আদরের ছিল। বোন যাতে ভালো থাকে, সে জন্য টাকার কোনো হিসাব করা হতো না। ঈদ বা প্রতি মাসেই বোনকে টাকা দিতাম। বোনের স্বামী যে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন, তা–ও পকেটে নিয়ে ঘুরছিলাম দেওয়ার জন্য। কিন্তু এর আগেই বোনটাকে মেরে ফেললওসমান গনি
হাসি বেগম বলেন, মেয়ের সংসারে অশান্তি বাড়বে ভয়ে তিনি তাঁর ছেলেকে টাকাটা দিয়ে আসতে বলেন। ছেলে সে টাকা পকেটেও রাখে। সন্ধ্যার দিকে হাসি বেগম মেয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন। মেয়ে তখন তার মেয়েদের জন্য বার্গার বানাচ্ছিল। তবে ভিডিও কলে মেয়ে মুখ দেখাতে চাচ্ছিল না। হাসি বেগম ভেবেছিলেন, মেয়ে যেহেতু বার্গার বানাচ্ছে, তাহলে মনে হয় অশান্তি থেমেছে।
ওসমান গনি বলেন, ঘটনার দুই দিন আগেও বোনের স্বামী অনলাইন গেমসে হেরেছেন জানিয়ে ২ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। পরে আবার ৫০ হাজার টাকা চান। ৭ আগস্ট রাত নয়টার দিকে বোনের স্বামী ফোন করে বলেন, আয়শা ঘরের দরজা খুলছে না। এ কথা শুনে আয়শার বাসায় গিয়ে দেখেন, মানুষের ভিড়। আয়শার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন সিঁড়িতে বসে আছেন। বাইরের কয়েকজন আয়শাকে সিঁড়ি দিয়ে নামাচ্ছেন। পরে ওসমান বোনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, আয়শা মারা গেছেন। পরে ঢাকা মেডিকেলে মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়।
৭ আগস্টও তিনি আয়শার মুঠোফোন থেকে ফোন করে আয়শার ভাই ওসমান গনির কাছে টাকা চান। এ সময় স্বামীর পাশ থেকে আয়শা জোরে জোরে ভাই যাতে আর টাকা না দেন সে কথা বলতে থাকেন।
আয়শা মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁর ছোট মেয়েকে দফায় দফায় চিকিৎসকের কাছে নিতে হচ্ছে। চিকিৎসক বলছেন, তাকে বেশি করে সময় দিতে হবে। কিন্তু হাসি বেগম মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে ছুটছেন মানববন্ধনে। তাঁর নিজের শরীরও ভালো না। তিন নাতনির ভবিষ্যতের চিন্তা তো আছেই। ঘটনার পর থেকে আয়শার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির কেউ আয়শার তিন মেয়ের খোঁজ নেননি বলে জানালেন হাসি বেগম।
হাসি বেগম অভিযোগ করে বলেন, আয়শা ছিল খুব চাপা স্বভাবের। বেশির ভাগ সময় স্বামীর নির্যাতনের কথা গোপন রাখতেন। নির্যাতন ও টাকার জন্য স্বামীর চাপ দেওয়া নিয়ে আগে পারিবারিকভাবে সালিসও হয়েছে।
আয়শাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসতে বলতেন জানিয়ে হাসি বেগম বলেন, কিন্তু মেয়ে স্বামীকে ভালো করতে চেয়েছিলেন। সংসারটা নিজের হাতে সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন। সংসার ও মেয়েদের ফেলে তিনি কোনোভাবে আত্মহত্যা করতে পারেন না।
ঘটনার পর থেকে আয়শার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির কেউ আয়শার তিন মেয়ের খোঁজ নেননি বলে জানালেন হাসি বেগম।
স্বামীর সঙ্গে আয়শার সম্পর্ক ভালো ছিল না, তা হাসি বেগম বুঝতে পারতেন। যমজ মেয়ে জন্মের পর আয়শার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাসপাতালে কোনো খোঁজ নেননি। হাসপাতালের বিল দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করেন হাসি বেগম নিজেই। মেয়ে ও নাতনিদের নিজের কাছে রাখেন পাঁচ মাস। ছেলে না হয়ে তিন মেয়ে হওয়া নিয়েও আয়শাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
হাসি বেগমের স্বামী মারা গেছেন ২০১৮ সালে। স্বামীর ব্যবসার হাল ধরেছেন ছেলে ওসমান গনি। আরেক ছেলে সালাউদ্দিন বিন তাহসীন এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।
এখন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত এটি হত্যা না আত্মহত্যার ঘটনা তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক মো. আবদুস শাকুর
ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দুই ভাইয়ের একটাই বোন ছিল। খুব আদরের ছিল। বোন যাতে ভালো থাকে, সে জন্য টাকার কোনো হিসাব করা হতো না। ঈদ বা প্রতি মাসেই বোনকে টাকা দিতাম। বোনের স্বামী যে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন, তা–ও পকেটে নিয়ে ঘুরছিলাম দেওয়ার জন্য। কিন্তু এর আগেই বোনটাকে মেরে ফেলল।’
আয়শার বিয়ের সময় ঘরের আসবাব কেনার জন্য ১৫ লাখ টাকা, বোনের স্বামী ব্যবসা করবে সেই বাবদ ৭ লাখ টাকা—এভাবে কত টাকা দিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই বলে জানালেন ওসমান গনি।
ওসমান গনি বলেন, ‘বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছেন, আমার বোন আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু বোনকে ওই বাড়ির লোকজন ছাড়া আর কেউ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে থাকতে দেখেনি। বোনের একটি আঙুল ভাঙা ছিল। চিকিৎসক বলছিলেন, বোনকে কিছু খাওয়ানো হয়েছিল, পুরো শরীর ফুলে কালচে হয়ে গিয়েছিল। নাক দিয়ে রক্তও বেরিয়েছিল। যদি বোন আত্মহত্যাই করবে, তাহলে বাড়ির সবাই পালাল কেন?’
ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক মো. আবদুস শাকুর আদালতে করা মামলাটির তদন্ত করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে ৭ আগস্ট। তখন দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতে পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি বা মাঠে ছিল না। আয়শার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে বলে শাহবাগ থানা–পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন করেছে। এখন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত এটি হত্যা না আত্মহত্যার ঘটনা তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’ এ ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।