কেউ লুটের শিকার, কেউ এক কাপড়ে ফিরেছেন

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সুদানফেরত বাংলাদেশিরা। ঢাকা, ৮ মে
ছবি: প্রথম আলো

সুদানে সংঘাত শুরু হলে রাজধানী খার্তুমের একটি ভবনে আটকা পড়েন বাংলাদেশি মো. সবুজ। এরই মধ্যে একদিন একদল লোক এসে ভবনের দরজা ভেঙে তাঁর কক্ষে ঢোকে। বন্দুকের মুখে টাকাসহ সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। হাতে টাকা নেই, ঘরে খাবার ও পানি নেই। বাইরে গোলাগুলি। এ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।

সোমবার সৌদি আরব থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানো সবুজ নিজের অভিজ্ঞতা এভাবে বর্ণনা করেন। তাঁর আতঙ্ক যেন কাটেনি, বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে গলা জড়িয়ে আসছিল তাঁর। তিনি বলেন, ‘জীবনে বহু কষ্ট করছি, এমন দিন দেখিনি। আল্লাহর ইচ্ছায় ও মা-বাবার দোয়ায় বেঁচে ফিরছি।’

সবুজের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। চার বছর আগে তিনি সুদান গিয়েছিলেন। সবুজের সঙ্গে সুদান থেকে ফেরা বেশির ভাগ বাংলাদেশির অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। কেউ লুটের শিকার হয়েছেন, কাউকে মারধর করা হয়েছে, কেউ শুধু পরনের কাপড় নিয়ে ফিরতে পেরেছেন, এমনকি পাসপোর্টও সঙ্গে নিতে পারেননি। সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।

কয়েক মাস আগে বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে সুদানের খার্তুমে গিয়েছিলেন প্রিন্স মোল্লা। যেতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জামাকাপড়, পাসপোর্ট, কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। যুদ্ধের কারণে গত দুই মাসের বেতনও দিতে পারেননি মালিক।’ খার্তুমে সাত দিন আটকা ছিলেন উল্লেখ করে প্রিন্স বলেন, ‘৭ দিন রুটি-পানি খেয়ে ছিলাম। দূতাবাসের বাসের মাধ্যমে আমাদের উদ্ধার করে ক্যাম্পে নেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পের অবস্থাও ভালো না। ৮০০ মানুষের জন্য দুটি শৌচাগার, লবণাক্ত পানি, ঘুমানোর জায়গা নেই।’

সুদানফেরত বাংলাদেশিদের অনেকে সঙ্গে করে কিছুই আনতে পারেননি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ৮ মে

গত ১৫ এপ্রিল সুদানে দেশটির সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম দফায় ১৩৬ বাংলাদেশিকে সুদান থেকে সৌদি আরবের জেদ্দায় নেওয়া হয়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজকের ফ্লাইটে ১৩৬ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি শিশু। গতকাল সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে ফ্লাইটটি ঢাকায় পৌঁছায়।

সংঘাতময় সুদান থেকে বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নিলেও কেউ কেউ স্বেচ্ছায় সুদানে থেকে যাচ্ছেন। মূলত ব্যবসায়ীরা দেশে ফিরতে চাচ্ছেন না। তাঁরা আরও কিছুদিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে চাইছেন। সুদান ফেরত মো. ওমর শেখ বলেন, ১৮ বছর ধরে সুদানে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা (কাপড়ের) আছে। তিনি নিজেও আট বছর থেকে ব্যবসা করছেন। মামাসহ পরিবারের চারজন সদস্য সুদানে থাকেন। তাঁর মামা ব্যবসা ফেলে দেশে আসতে রাজি হননি। ওমর শেখ বলেন, ‘আমাদের দোকানের সামনেও বোমা পড়ছে, ১৮ জন মারা গেছেন।’

সুদানফেরত বাংলাদেশিদের নগদ টাকা তুলে দেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ৮ মে

বিমানবন্দরে চাঁদপুরের মো. রাকিব বলেন, বড় ভাই, ভাবি ও তিনি সুদানে থাকতেন। সেখানে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। ব্যবসার কারণে তাঁর বড় ভাই সুদানে রয়ে গেছেন। তিনি ও তাঁর ভাবি দেশে ফিরেছেন।

শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. ছিদ্দিকুর রহমান সুদানফেরত বাংলাদেশিদের স্বাগত জানান। মন্ত্রী ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ৯ বা ১০ মে (মঙ্গলবার বা বুধবার) সুদান থেকে বাংলাদেশিদের পরবর্তী ব্যাচ দেশে ফেরার কথা রয়েছে। অতিসত্বর বাকিদের ফিরিয়ে আনা হবে। দেশে ফেরা সবাইকে নিবন্ধন করার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সবাইকে নিবন্ধন করতে হবে, যাতে ফেরত আসা ব্যক্তিদের কল্যাণে কাজ করা যায়।

বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, যাতে শূন্য হাতে ফেরা প্রবাসীরা বাড়ি ফিরতে পারেন। এ সময় তাঁদের খাবারও সরবরাহ করা হয়।

আইওএম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সুদানে বাংলাদেশের দূতাবাস ও জেদ্দা কনস্যুলেটের সহায়তায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আইওএম সুদান থেকে বাংলাদেশিদের ফেরানোর কার্যক্রম শুরু করে।

এদিকে সুদান দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, আটকে পড়া বাংলাদেশিদের পরের দফায় দু-এক দিনের মধ্যে ফেরানো সম্ভব হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।