সেদিন ছিল মঙ্গলবার। হেমন্তের প্রথম দিন। নারায়ণগঞ্জ শহরে দুপুরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকেও রয়ে গেছে মেঘলা ভাবটা। সন্ধ্যা নামছে চারপাশে। শ্মশানে এক যুবকের দেহ দাহ করা হচ্ছে। যুবকের অল্প বয়সী বউ স্বামীর চিতার কিছু দূরেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। চিতার কাছেই শিবমন্দির ও কালীমন্দিরে চলছে পূজার আয়োজন।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে শ্মশান থেকে একটু দূরত্বে যে কবরস্থান, সেখানে মুসলমান একজনের লাশ দাফন করে খালি খাটিয়া নিয়ে বের হচ্ছেন স্বজনেরা। শ্মশান আর কবরস্থানের মাঝে খ্রিষ্টানদের কবরস্থান। সেখানে পিনপতন নীরবতা।
নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন পরিচালিত মাসদাইর কেন্দ্রীয় কবরস্থান, কেন্দ্রীয় সিটি শ্মশান ও খ্রিষ্টান সিটি কবরস্থানের অবস্থান পাশাপাশি। মোট জায়গা ১০ একর। কবরস্থান ও মসজিদের সামনে একটি মূল ফটক। আবার কবরস্থান, শ্মশান ও খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে যাওয়ার জন্যও তিনটি আলাদা ফটক। যেকোনো ফটক দিয়ে ঢুকে যে কেউ শ্মশান বা কবরস্থানে যেতে পারেন।
সেদিন মুসলমানদের কবরস্থানে দুজনের লাশ দাফন করা হয়। আর শ্মশানে দাহ করা হয় একজনের। শ্মশানে ঢাক ও ঢোলের শব্দ, বাজছে শঙ্খ। কেন্দ্রীয় মসজিদে আজান হচ্ছে, মুসল্লিরা মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়ে বের হচ্ছেন। মসজিদ ও শ্মশান পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সমঝোতায় এসেছেন, তাই আজান ও নামাজের সময়টুকুতে শ্মশানে ঢাকঢোল বাজানো বন্ধ থাকে। আর বাকি সময়টুকুতে যে যাঁর ধর্মীয় রীতিতে যা যা করণীয়, তা করেন। এ শ্মশানে হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধদেরও দাহ করা হয়। অর্থাৎ জায়গাটি মৃত্যুর পর শেষযাত্রায় চার ধর্মের মানুষের মহামিলনস্থলে পরিণত হয়েছে।
তবে এই কবরস্থান, শ্মশান ও খ্রিষ্টানদের কবরস্থানটি কবে থেকে যাত্রা শুরু করেছে, তার লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। ব্রিটিশ আমলে হর কান্ত ব্যানার্জি নামের একজন জনপ্রতিনিধি এই জায়গা দান করেছিলেন বলে প্রচার আছে।
৩২ বছর ধরে দলিল লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এস এম কামরুজ্জামান ১৯১০ থেকে ১৯১৩ সালের মাসদাইর মৌজার সিএস জরিপ নকশা বের করে জানালেন, কবরস্থান, শ্মশানের বয়স ১০০ বছর পার হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কবরস্থান ও শ্মশানের মাঝখানে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানটি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বিও বললেন, যেটুকু নথি আছে, তা অনুযায়ী, ১৮৮২ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে কবরস্থান ও শ্মশানটি যাত্রা শুরু করেছিল।
সরেজমিনে দেখা গেল, শ্মশানে অনেক সমাধি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কবরস্থানের অনেক নামফলক এত পুরোনো যে তা আর পড়া যায় না। ১৯২৮ সালে খুন হয়েছিলেন জে কে সেন নামের একজন, তাঁর সমাধিতে ‘ব্রুটালি মাডার্ড’ কথাটি লেখা। সমাধির নামফলকটি কোনো রকমে পড়া যাচ্ছে এখনো। খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে ঢোকার মুখেই লেখা—শান্তিতে ঘুমাও।
মুসলমানদের কবরস্থানে দায়িত্ব পালন করছেন হাফেজ মাওলানা জাকারিয়া মোমেন। তাঁর মতে, নারায়ণগঞ্জের এ জায়গা বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ভ্রাতৃত্ববন্ধনের অনন্য নজির স্থাপন করেছে। একই কথা ২৮ বছর ধরে শ্মশানে দায়িত্ব পালন করা বর্তমানে প্রধান পুরোহিত শান্তি ঘোষালের মুখেও—এখানে ধর্মীয় উগ্রতা নেই। প্রয়োজনে যাঁরা কবরস্থানে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরাও শ্মশানের কাজে সহযোগিতা করেন। তাঁরা এখানে ভাই বা বন্ধুর মতোই পাশাপাশি থাকেন।
২২ বছর ধরে কেন্দ্রীয় সিটি কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা পিন্টু পলিকাপ পিউরিফিকেশন বললেন, জায়গাটি মৃত্যুর পর চার ধর্মের মানুষের মহামিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের বলে রেখেছেন, মৃত্যুর পর তাঁর কবরটিও যাতে এ কবরস্থানেই হয়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার। দুই দশক ধরে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের কেন্দ্রীয় কবরস্থান ও শ্মশান পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
মাকছুদুল জানালেন, অনেক টাকা খরচ করে সিটি করপোরেশন জায়গাটির উন্নয়ন করেছে। আগে মানুষ কবরস্থান বা শ্মশানের নাম শুনলে ভয় পেতেন। এখন একদিকে ধর্মীয় সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি, অন্যদিকে ফটকসহ নান্দনিক অবকাঠামো দেখতে মানুষ এখানে বেড়াতেও আসেন।