পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না করে সরকার অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, চুক্তির পর এখন সরকার ভাবছে, তাঁদের (পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী) স্বার্থ না দেখলেও চলবে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি তারা (সরকার) তৈরি করেছে। এটার বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। কোনো অসততা করে মানুষকে বোকা বানানো যায় না।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন ও পার্বত্য আদিবাসীদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন সুলতানা কামাল। গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার ভবনে যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)।
* পার্বত্য চুক্তিতে সরকার যা লিখেছিল, তা কি তারা আদৌ চেয়েছিল—এমন প্রশ্ন তুলেছেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়।* প্রতিকূলতা–সীমাবদ্ধতা থাকলেও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্যেই শান্তি নিহিত বলে মনে করেন পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান।
সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামাল বলেন, সরকার নিজে চুক্তি করে এখন তা মানছে না। ভাবছে, জনগণকে বোকা বানিয়ে আইন ও চুক্তি ভঙ্গ করে নিরাপদে টিকে থাকা যাবে। কিন্তু কোনো অসততা দিয়ে, মোনাফেকি দিয়ে দেশের মানুষকে বোকা বানানো যায়নি, যাবেও না।
সেমিনারে সভাপতিত্বের পাশাপাশি সঞ্চালকের দায়িত্বও পালন করেন সুলতানা কামাল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, কোনো জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা হলে বাংলাদেশ সব মানুষের দেশ হিসেবে আর থাকবে না। কিছু মানুষের দেশ হয়ে যাবে।
রক্তপাত বন্ধ করে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ২৬ বছর আগে করা এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি।
বহুত্ববাদী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারছে কি না, সেমিনারে এই প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘পাহাড় ও সমতলের সংখ্যালঘুদের আজকে যে দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পর অথবা যেকোনো সময় কি ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি সবাইকে হতে হবে? ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের কথা বলছি, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?’
রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে দেশ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা ভাবছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন রানা দাশগুপ্ত।
পার্বত্য চুক্তিতে সরকার যা লিখেছিল তা কি তারা আদৌ চেয়েছিল—এমন প্রশ্ন তুলেছেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তিনি। প্রবন্ধে তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের কোন কোন জায়গায় ব্যর্থতা আছে তা সরকার উল্লেখ করে না। চুক্তির মৌলিক বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, স্থানীয় প্রশাসনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি, কার্যকর ভূমি কমিশন—এসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ইঙ্গিত করে দেবাশীষ রায় বলেন, ‘খেলোয়াড়’–এর সংখ্যা বেড়ে গেছে। মাঝেমধ্যে এদের অনেককে সরকারি সংস্থার গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়। সরকারি সংস্থার আশপাশে তাদের ঘুরতে দেখা যায়।
সেমিনারে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, চুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়িত না করেও তা পূরণ করা হয়েছে বলে দাবি করছে সরকার। তবে প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা করা ঠিক হবে না। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্যেই শান্তি নিহিত বলে মনে করেন তিনি।
পার্বত্য অঞ্চলের যুব সমাজকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘প্রচার চালাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভীষণ যুদ্ধ চলছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এগুলো ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে করা হচ্ছে। ইচ্ছা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে আমরা বিচ্ছিন্নতা চাই। সেটা ঠিক নয়।’
দেশে যে আধিপত্যবাদ ও নিয়ন্ত্রণবাদের অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, তারই প্রভাব পার্বত্য অঞ্চলে পড়ছে বলে মনে করেন নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। সঞ্জীব দ্রং বলেন, পার্বত্য চুক্তির বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের সংলাপ প্রয়োজন। ২৬ বছর ধরে পার্বত্যবাসী একধরনের ধোঁকার মধ্যে আছেন। চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারের একটু সৎ হওয়া দরকার।