আর্জেন্টিনার সমর্থক আবদুল জলিল ওরফে স্বপন মামা ৩৮ বছর ধরে টিএসসিতে চা বিক্রি করছেন
আর্জেন্টিনার সমর্থক আবদুল জলিল ওরফে স্বপন মামা ৩৮ বছর ধরে টিএসসিতে চা বিক্রি করছেন

টিএসসির ‘স্বপন মামার’ চোখে ম্যারাডোনা ও মেসির বিশ্বকাপ জয়

আবদুল জলিল ওরফে স্বপন ৩৮ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) প্রাঙ্গণে চা বিক্রি করেন। ক্যাম্পাসের রাজনীতি, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, সংকট আর উৎসবের নীরব সাক্ষী তিনি। ভালোবেসে শিক্ষার্থীরা তাঁকে ‘স্বপন মামা’ নামে ডাকেন।

বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দে গোটা এক মাস মাতোয়ারা ছিল বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশ্বকাপ ঘিরে বেশ কয়েকটি বড় পর্দা স্থাপন করা হয় যাতে একসঙ্গে খেলা দেখেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের একজন ছিলেন স্বপন মামা। তিনি আর্জেন্টিনার পাঁড় সমর্থক। টিএসসিতে বসেই তিনি দেখেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ জয়। ৩৬ বছর পর সেখানে বসেই এবার দেখলেন ম্যারাডোনার উত্তরসূরি লিওনেল মেসির হাতে সোনার শিরোপা।

পরিবারের হাল ধরার দুর্ভাবনা মাথায় নিয়ে স্বপন মামা টিএসসিতে এসেছিলেন ১৯৮৪ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর। এখানে এসে একটি চায়ের দোকানে চাকরি নেন তিনি। টিএসসি আসার দুই বছর পর ছিল ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনার তখন বিশ্ব ফুটবলের চূড়ায় ওঠার সময়। সে জন্য টিএসসিতে খেলা দেখার ব্যবস্থা করেন স্বপন মামাসহ কয়েকজন।

স্বপন মামা প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলার দেখার জন্য আমরা এক হাজার টাকায় এক মাসের জন্য ২১ ইঞ্চির একটা রঙিন টিভি ভাড়া করে এনেছিলাম। তখন তো এত মানুষ আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করত না। টিএসসির কর্মচারীদের সঙ্গে আমরা খেলা দেখতাম। তাঁদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই।’

টিএসসিতে বসেই স্বপন মামা দেখেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ জয়। ৩৬ বছর পর সেখানে বসেই এবার দেখলেন ম্যারাডোনার উত্তরসূরি লিওনেল মেসির হাতে সোনার শিরোপা।

গত রোববার রাতে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল জেতার পর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশে উৎসবের কেন্দ্র হয়ে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে থেকে সমর্থকেরা ঢাকঢোল, ভুভুজেলা, আতশবাজি নিয়ে এসে এখানে আনন্দ করেছেন। তবে ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর এখানে এমন চিত্র ছিল না বলে জানান স্বপন মামা। তিনি বলেন, তখন শিক্ষার্থীরা খেলা দেখতেন নিজেদের হলে। মানুষের বাসায় টেলিভিশন কম ছিল। খেলা গভীর রাতে হওয়ায় অনেকে দেখতেও পারতেন না। খেলা নিয়ে এখনকার মতো উন্মাদনাও ছিল না। এ ছাড়া আর্জেন্টিনার সমর্থক তখন তুলনামূলক কম ছিল। সে জন্য টিএসসিতে এমন উৎসবমুখর পরিবেশ তখন ছিল না।

স্বপন মামা জানান, ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন উৎসবমুখর চিত্র ছিল না

চার বছর পরপর বিশ্বকাপ এলে কোটি ভক্তের মতো আর্জেন্টিনাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন স্বপন মামা। তবে প্রতিবারই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাঁর। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন ২০১৪ সালের ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর। তিনি বলেন, ‘সেবার তো ভোররাতে খেলা হইল, মামা। একেবারে শেষ মুহূর্তে হাইরা গেলাম আমরা। খুব কষ্ট পাইছি। দুঃখে দুই দিন দোকান বন্ধ রাখছিলাম।’ এবারও এমন পরিস্থিতি হয়েছিল একবার। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের সঙ্গে হারার পর দুই ঘণ্টা দোকান বন্ধ রেখেছিলেন তিনি। তবে এবার দুঃখে নয়, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দলের সমর্থকদের ট্রল থেকে রক্ষা পেতে দোকান বন্ধ রাখেন বলে দাবি তাঁর।

স্বপন মামা বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে হারার পরও আমার বিশ্বাস ছিল আর্জেন্টিনা এবার ফাইনাল খেলবে। সেটা তো হইলোই। ফাইনালে যখন আর্জেন্টিনা আগায়ে ছিল, তখন তো আমরা খুশি। কিন্তু ফ্রান্স যখন উল্টো গোল দিয়া দিলো, তখন খুব নার্ভাস হয়ে পড়ছিলাম। তবুও আমার মন বলতেছিল, টাইব্রেকারে গেলে আর্জেন্টিনা জিতে যাবে। সেটাই হইছে।’

গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের সঙ্গে হারার পর দুই ঘণ্টা দোকান বন্ধ রেখেছিলেন স্বপন মামা। দুঃখে নয়, ব্রাজিল সমর্থকদের ট্রল থেকে রক্ষা পেতে

আর্জেন্টিনা দলের চেয়েও স্বপন মামা বেশি ভালোবাসেন লিওনেল মেসিকে। একসময় এমন ভালোবাসতেন মেসির পূর্বসূরি ম্যারাডোনাকে। তিনি বলেন, ‘মেসি আর ম্যারাডোনা যত সুন্দর করে ফুটবল খেইলা গেছেন, একটা কইরা কাপ না পাইলে এটা তাঁদের প্রতি প্রকৃতির অবিচার হইয়া যাইতো। একটা কইরা কাপ তাঁদের প্রাপ্য ছিল। আমারও সৌভাগ্য এই টিএসসিতে বইসা প্রিয় দুই প্লেয়ারের হাতে দুইটা কাপ দেখলাম।’