সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় করে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যক্ষ্মা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই পুরোপুরি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। রংপুরে ‘যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন।
গতকাল রোববার বিকেলে রংপুর নগরের আরডিআরএস বাংলাদেশের মিলনায়তনে এই গোলটেবিল বৈঠকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই এ বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। সভায় শনাক্তের বাইরে থাকা যক্ষ্মারোগীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক প্রচারের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে।
গোলটেবিল বৈঠকটি স্টপটিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় যৌথভাবে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও প্রথম আলো। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির এসিটিবির পিপিএম পরামর্শক আবু তালেব।
অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (টিবি) মাহফুজার রহমান সরকার। তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কাজ করছে। এর সঙ্গে অন্য এনজিওগুলো আছে, তারাও আমাদের সঙ্গে কাজ করে। সেই সঙ্গে বেসরকারি অংশীদার যারা আছে, তারাও আমাদের সঙ্গে কাজ করে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে যদি সবাই যুক্ত না হয়, তাহলে কখনোই সফল হওয়া সম্ভব নয়।’
মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘২০ থেকে ২১ শতাংশ ডায়াগনোসিস করতে পারছি না, কোনো কারণে মিসিং হয়ে গেছে। যাদের ডায়াগনোসিস করতে পারছি না, তারা কিন্তু মিসিং থেকেই যাচ্ছে।’
মাহফুজার রহমান সরকার আরও বলেন, আগে শুধু একটা এনালগ এক্স-রে করে টিবি ডায়াগনোসিস করতে হয়েছে। ডিজিটাল এক্স-রে ছিল না। এখন জিন এক্সপার্ট যন্ত্র এসেছে। উপজেলাসহ সব জায়গায় এ যন্ত্র আছে। ফলে খুব সহজেই যক্ষ্মারোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে।
রংপুর বিভাগীয় যক্ষ্মাবিশেষজ্ঞ ডা. রানা চৌধুরী বলেন, ‘যক্ষ্মা নিয়ে আমাদের সফলতার হার কিন্তু অনেক বেশি। যার উদাহরণ জিন এক্সপার্ট যন্ত্র। পুরো রংপুর বিভাগের সবখানেই জিন এক্সপার্ট যন্ত্র আছে। এই যন্ত্র আরও অনেক জায়গায় দেওয়ার ইচ্ছে আছে।’
রংপুরের ডেপুটি সিভিল সার্জন রহুল আমিন বলেন, ‘একজন টিবি (যক্ষ্মা) রোগীকে চিকিৎসা দিতে গেলে সরকারকে বিনা মূল্যে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যক্ষ্মারোগীর পাশে দাঁড়াতে সরকার এই কাজ করে যাচ্ছে। আমরা রংপুর জেলায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন এমন ১৭০ জন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সরকারিভাবে আমাদের সচেতনতা কার্যক্রম চলমান আছে। সবার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ চাই। আমরা আশাবাদী।’
সমাপনী বক্তব্যে ইউএসএআইডির এসিটিবি পরামর্শক ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্রতিটি উপজেলায় চলে জিন এক্সপার্ট যন্ত্র। দুই ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল। কোনো চিকিৎসার ক্ষেত্রে ফি নেওয়া হয় না। আমরা প্রতিটি হাসপাতালে যাব। যক্ষ্মারোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।’
রংপুর মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এস এম রওশন আলম বলেন, ‘যক্ষ্মারোগের জীবাণু এখনো আমাদের শরীরে রয়ে গেছে। আমরা জানি না, দেখি না। এ জন্য আমাদের নাগরিক অংশগ্রহণে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে একটি গণ-আন্দোলন হওয়া উচিত।’
ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির বিভাগীয় ব্যবস্থাপক জাফরুল আলম প্রধান বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ জেলখানায়ও যক্ষ্মারোগীর সেবা দিয়ে আসছে ব্র্যাক। অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েও আমাদের জেলখানায় যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক বাধাবিপত্তিও হয়। যক্ষ্মা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা (ব্র্যাক) সারা দেশে ৬২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার করেছি। ডায়াগনোসিসের ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।’
গুড হেলথ হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক ডা. সৈয়দ মামুনুর রহমান বলেন, যক্ষ্মারোগী ২১ শতাংশ নির্ণয় হচ্ছে না। যারা শনাক্ত হচ্ছে না, তারাই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৭০ ভাগ রোগীকে বেসরকারিভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। টিবি রোগ নির্ণয়ে যে সমন্বিত ব্যবস্থা থাকা লাগে, সে ধরনের ব্যবস্থা নেই, প্রশিক্ষণও নেই। তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যেহেতু আমি বিভাগীয় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পদে আছি, আমি কোনো তথ্য পাই না।’
যক্ষ্মা নিরসনে চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলা প্রসঙ্গে আপডেট ডায়াগনস্টিকের প্রধান ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ডা. নূরুল হাসান বলেন, যক্ষ্মারোগ এখনো ৩০ শতাংশ শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এটি ভেবে দেখার বিষয়। এই আসল জায়গায় হাত দেওয়া হয়নি। সরকারি পর্যায়ে অবহেলা রয়েছে। সেখানে বেসরকারি পর্যায়ে যক্ষ্মারোগের সেবা দেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি করে। যক্ষ্মারোগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আল আমিন বলেন, যক্ষ্মা চিকিৎসাসেবায় বেসরকারি খাতকে আরও কীভাবে যুক্ত করা যায়, সেটি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। সরকারিভাবে প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
আলোচক হিসেবে আরও ছিলেন আরডিআরএস বাংলাদেশের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর বজলুর রশিদ, রংপুর প্রাইম মেডিকেলের প্রধান নির্বাহী (বিপণন) এম এ জলিল খান, দ্বীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. খায়রুল ইসলাম, এনটিপির ডিএসএমও ডা. মাবুদ উজ জামান, রংপুর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার সিদ্দিকী, স্থানীয় পত্রিকা সকালের বাণীর প্লানিং এডিটর ফরহাদুজ্জামান।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলো রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক।