বাসা খুঁজতে গিয়ে ‘টু লেট’ দেখে একটি নম্বরে ফোন দেন জারা রহমান। অপর প্রান্তে ফোন ধরেন বাড়িওয়ালা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে বাসা ভাড়া ঠিক হয়। কিন্তু জারা যখন বলেন, তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত নারী (ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছেন), সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে দেন বাড়িওয়ালা। জারার মুঠোফোন নম্বরটিও ব্লক করে দেন।
জারা রহমান বলেন, ‘সরাসরি বাড়ি খুঁজতে গেলে এক বয়স্ক বাড়িওয়ালি ভাড়া ঠিকঠাক করে জানালেন, আমাকে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। এরপর তাঁকে যখন ট্রান্স উইমেন বলে আমার পরিচয় দিলাম, তিনি বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারলেন না। তখনো বললেন, সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁকে যখন জানালাম আমি ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছি, তখন দৌড় দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। এরপর তাঁর স্বামীকে পাঠালেন। তিনি এসে বললেন, তাঁরা কোনো হিজড়াকে বাসা ভাড়া দেবেন না।’ রাজধানীর মহাখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে জারা রহমানের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
তবে জারার ভোগান্তির অবসান হয়েছে। তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে সিট পেয়েছেন। দেশে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ৯টি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল রয়েছে। জারা রহমানই প্রথমবারের মতো ট্রান্স উইমেন বা রূপান্তরিত নারী পরিচয়ে সরকারি হোস্টেলে সিট পেতে যাচ্ছেন।
গত শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে জারা রহমান বলেন, ‘বাসা নিয়ে সমস্যায় আছি, এটা জানার পর ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী হো চি মিন ইসলাম আমাকে নিয়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে যান। আমরা দুজনই ভেবেছিলাম, সেখানে গিয়ে আসলে কোনো লাভ হবে না। তবে অবাক হলাম, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিলেন। সিট পেতে হলে কী কী করতে হবে, সব বলে দিলেন। যে হোস্টেলে সিট পেতে যাচ্ছি, সেখানকার হোস্টেল সুপারকে নির্দেশনা দিলেন। ট্রান্সজেন্ডার হয়ে এত সহজে সরকারি হোস্টেলে সিট পাব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।’
এমবিএ করা জারা রহমান দুই বছর ধরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মানবসম্পদ বিভাগের অধীনে পে–রোল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রূপান্তরিত নারী পরিচয়েই ব্র্যাকের চাকরি পেয়েছেন। চাকরির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জারা রহমান জানালেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্র্যাকের চাকরিটি পান। এর আগে ঢাকার বাইরে ছিলেন। ব্র্যাক থেকে এক মাস সময় দেওয়া হয় বাসা ভাড়া নেওয়াসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। তখনই বাড়ি খুঁজতে গিয়ে নানা ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন। বাসা ভাড়া পাওয়া না গেলে চাকরিতে যোগ দেওয়াই সম্ভব হতো না। পরে মহাখালী এলাকায় তাঁর সমগোত্রীয় একজনের সঙ্গে থাকেন, তবে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছিল।
বর্তমানে উত্তরায় আছেন আরেকজন রূপান্তরিত নারীর সঙ্গে। অবশেষে সরকারি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে সিট পাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন জারা রহমান। এখন আপাতত নিশ্চিন্ত। সব ঠিক থাকলে ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে মিরপুরের নওয়াব ফয়জুন্নেছা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন।
ব্র্যাকে চাকরি পাওয়ার পর থেকে জারা রহমান নতুন পরিচয়ে পরিচিত হতে শুরু করেছেন। তাঁর নতুন পরিচয় ঢাকার বাইরে থাকা পরিবারের অনেকেই জানেন না।
জারা ব্র্যাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বললেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ট্রান্সজেন্ডারদের সেভাবে মূল্যায়ন করে না। তবে ব্র্যাক এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অফিসের নিরাপত্তাকর্মীরাও ট্রান্সজেন্ডারবান্ধব বা সংবেদনশীল আচরণ করেন।
জারা ছোটবেলা থেকেই মনের ভেতরের পরিবর্তন বুঝতে পারতেন। ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়ে মেয়েদের মতো পোশাক কিনতে ইচ্ছা করত। মেয়েদের মতো আচরণের জন্য স্কুল, কলেজে নানান ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। ছেলেরা গায়ে ধাক্কা দিয়ে বাজে প্রস্তাব দিত। পরিবারের সদস্যরাও হয়তো বিষয়গুলো বুঝতেন, তবে কখনোই এ নিয়ে মারধর করা বা গালাগালি করেননি।
জারা বলেন, ‘ব্র্যাকে চাকরি পাওয়ার আগপর্যন্ত আমি একজন পুরুষের মতোই পোশাক পরতাম। আমি জানতাম আমার পরিচয় প্রকাশ করলে পরিবার, সমাজ কেউ মেনে নেবে না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। আর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পড়াশোনা করা হবে না। পরিবার থেকে টাকা নিয়েই আমি পড়াশোনা করেছি। ব্র্যাকে যোগ দেওয়ার পর চাকরির পাশাপাশি এমবিএ সম্পন্ন করেছি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে জারা বলেন, মাদকসেবী, চোর—এমন সন্তানকেও পরিবার মেনে নেয়। শুধু তাঁদের মতো ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের পরিবার মেনে নিতে পারে না। অথচ তাঁরা তো নিজে থেকে এমন হননি। হরমোনসহ নানা বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তবে এসব কেউ শুনতে চায় না, মানতে চায় না।
জারা জানালেন, ‘ছোটবেলায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম, ঘুম থেকে জেগেই যাতে নিজেকে মেয়ে হিসেবে দেখতে পাই। কিন্তু তা তো আর হতো না। ছোটবেলায় প্রায় সময়ই ভাবতাম, আমার আশপাশের আর কারও সঙ্গে তো এমন হয়নি, তারা হয় নারী না হয় পুরুষ। অথচ আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি নিজেকে তো মেয়ে ভাবি। অন্য একজন মেয়ে যেভাবে চিন্তা করে, আমিও তো সেভাবেই চিন্তা করি।’
মহিলা হোস্টেলের অন্য নারীরা তাঁকে যদি মেনে না নেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে জারা বলেন, সে সম্ভাবনা তো আছেই। তাই একক সিটে থাকতে চাচ্ছেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তারাও হোস্টেলে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেটি দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
জারা রহমান হোস্টেলে সিট পাওয়ার জন্য একটি ফরম পূরণ করেছেন। সেখানে বিভিন্ন নথিতে থাকা পুরুষ নামটি প্রথমে লিখেছেন। আর ব্র্যাকেটে লিখে দিয়েছেন বর্তমান নামটি।
রাজধানীর নীলক্ষেতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের (আগে নাম ছিল নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল) সুপার ছামিনা হাফিজ। তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মিরপুরের নওয়াব ফয়জুন্নেছা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলটিরও সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ছামিনা হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে কোনো ট্রান্সজেন্ডার সরকারি হোস্টেলে সিটের জন্য আবেদন করেননি। জারা রহমান প্রথমবারের মতো আবেদন করেছেন। হোস্টেলে সিট পেতে হলে যেসব ক্রাইটেরিয়া (শর্ত) থাকা প্রয়োজন, তা ওনার আছে। ওনাকে একটি একক সিট দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে, যাতে তিনি হোস্টেলে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন।’
হোস্টেল সুপার আরও বলেন, সরকার ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। জারা রহমানকে সিট দিতে পেরে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও খুশি হয়েছেন। তিনি হোস্টেলে থাকার পর কোনো কোনো নারী এ নিয়ে আপত্তি তুলতে পারেন। তবে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়, তা সার্বিকভাবে নজরদারি করা হবে। এ ছাড়া বর্তমানে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়েছে।