রায় ঘোষণার পর চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে বিএনপির নেতা–কর্মীদের সঙ্গে শাহাদাত হোসেন। আজ দুপুরে
রায় ঘোষণার পর চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে বিএনপির নেতা–কর্মীদের সঙ্গে শাহাদাত হোসেন। আজ দুপুরে

কোন যুক্তিতে বিএনপির প্রার্থী শাহাদাতকে চট্টগ্রামের মেয়র ঘোষণা

তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে (চসিক) পূর্বপরিকল্পিত তামাশার, প্রহসনের নির্বাচন উল্লেখ করে বিচারক বলেছেন, সরকারদলীয় মনোনীত প্রার্থীকে মেয়র ঘোষণা দেওয়া কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতামাত্র। আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে এই মন্তব্য করা হয়।

বাদীর আইনজীবী মফিজুল হক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির প্রমাণ পেয়েছেন আদালত। এ জন্য বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে চসিকের মেয়র ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর নির্বাচিত হওয়ার ফলাফল বাতিল ঘোষণা করেন আদালত। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির আদেশও দিয়েছেন।

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাহাদাত হোসেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট পান। একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ৯ জনকে বিবাদী করে মামলাটি করেছিলেন পরাজিত মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন।

ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তৎকালীন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আর কার্যালয়ে আসেননি। মেয়রকে অপসারণ করে ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলামকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর আদালত থেকে আজ এ রায় এল।

‘পূর্বপরিকল্পিত তামাশার নির্বাচন’

আদালত সূত্র জানায়, রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক মোহাম্মদ খাইরুল আমীন বলেছেন, নির্বাচনের দিনের নির্বাচনী চিত্র, ঘটনা ও অনিয়ম এবং স্থানীয়, জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব প্রকাশিত অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের পাহাড়সম অভিযোগে প্রতীয়মান হয় যে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০২১ একটি পূর্বপরিকল্পিত তামাশার, প্রহসনের এবং সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীকে মেয়র ঘোষণা দেওয়ার কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতামাত্র।’

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সব ভোটারের অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাদী (শাহাদাত হোসেন) বিপুল ভোটের ব্যবধানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচিত হতেন বিবাদীর (রেজাউল করিম) বিপক্ষে। বাদীর ফলাফলের পার্থক্য সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ভোটের ফলাফলে সই করেন। কিন্তু কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশে জালজালিয়াতি ও চরম অনিয়মের চিত্র স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়। বিবাদীরা নির্বাচনী আইন ও বিধিমালাকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে ১ নম্বর বিবাদী রেজাউল করিমের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়ে অন্যায় ও অবৈধভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বাদী বেআইনি ভোটারবিহীন তামাশা ও প্রহসনের নির্বাচনের ফলাফলের প্রজ্ঞাপন বাতিল ঘোষণার প্রার্থনা করেন। একই সঙ্গে বাদীকে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০ অনুসারে মেয়র পদে বিজয়ী ঘোষণার প্রার্থনা করেন। বাদীর উল্লেখিত দাবির সত্যতা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়। এমতাবস্থায় নির্বাচনী বিধিবিধান প্রতিপালন না করে সম্পূর্ণ অন্যায় ও বেআইনিভাবে রেজাউল করিমকে বিতর্কিতভাবে নির্বাচিত করে বিগত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়।

আগের ফলাফল বাতিলের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০–এর ৬১(৫) ধারা উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে। এ ধারায় বলা হয়, ‘নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল নির্বাচনী দরখাস্ত শুনানির পর কোনো নির্বাচিত প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করতে পারবে, যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ বা বেআইনি আচরণ দ্বারা নির্বাচনী ফলাফল অর্জন করা হয়েছে বা উক্তরূপ ফলাফল অর্জনের জন্য উক্ত কার্যকলাপ বা আচরণ করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরস্পর যোগসাজশে কোনো দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ বা বেআইনি আচরণ করা হয়েছে।’

রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১ নম্বর বিবাদী (রেজাউল করিম) নির্বাচিত ঘোষণা করার নিমিত্তে রিটার্নিং অফিসারসহ বিবাদীর নির্বাচনী এজেন্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০, সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬ এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচন (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিধিমালা ২০১৯ চরমভাবে লঙ্ঘন করেছেন। একই সঙ্গে দুর্নীতি, বেআইনি ও যোগসাজশমূলক কার্যকলাপ এবং আচরণের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন।