হজ ব্যবস্থাপনা দল

সরকারি খরচে সৌদি আরব যেতে তদবির কর্মকর্তাদের

ধর্ম মন্ত্রণালয়
ধর্ম মন্ত্রণালয়

সরকারি হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হিসেবে সরকারি খরচে সৌদি আরবে যেতে রীতিমতো ‘তদবির’ শুরু করেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেউ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুপারিশের চিঠি নিয়ে আসছেন, কেউ কেউ ফোন করাচ্ছেন, কেউ কেউ নিজেরাই ধর্ম মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ‘তদবির’ করছেন। এই তদবিরে বিরক্ত ধর্ম মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হয়ে সৌদি আরবে যেতে আবেদন করেছেন চার হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তা, প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত কর্মচারী ও সচিবদের গানম্যানও।

আবেদনকারীদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু তাঁরা সরকারি খরচে সৌদি আরবে যেতে চেষ্টা করছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্যদের পেছনে সরকারের গড়ে ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। তাঁদের কাজ হলো হজযাত্রীদের সেবা দেওয়া। তবে অভিযোগ আছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তাদের অনেকে সরকারি খরচে সৌদি আরবে গিয়ে ঘুরে বেড়ান, কেনাকাটা করেন। কর্মচারীদের কাউকে কাউকে হজযাত্রীদের বদলে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সেবা দিতে ব্যস্ত থাকতে হয়।

এদিকে আবেদনকারীদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু তাঁরা সরকারি খরচে সৌদি আরবে যেতে চেষ্টা করছেন।

বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে ধর্মসচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, হজের কাজের সঙ্গে যাঁরা প্রাসঙ্গিক, যাঁরা অভিজ্ঞ, এবার তাঁদের সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে। যাঁদের সঙ্গে হজের কাজের কোনো সম্পর্ক নেই, তাঁদের পাঠানোর সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, কাউকে সৌদি আরবে পাঠালে তাঁর পেছনে সরকারের খরচ হয় গড়ে ৫ লাখ টাকা। তাহলে কেন অপ্রয়োজনে তাঁকে নেওয়া হবে?

ধর্মসচিব আরও বলেন, সরকারি হজ ব্যবস্থাপনা দলে লোকের সংখ্যা গতবারের তুলনায় এবার অর্ধেকে নেমে আসবে। যে কাজের জন্য তাঁরা যাবেন, সে কাজই তাঁদের করতে হবে।

কাউকে সৌদি আরবে পাঠালে তাঁর পেছনে সরকারের খরচ হয় গড়ে ৫ লাখ টাকা। তাহলে কেন অপ্রয়োজনে তাঁকে নেওয়া হবে?
ধর্মসচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার

যাঁরা যেতে চান

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে হজ ব্যবস্থাপনা দলে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহী কর্মকর্তাদের অনেকের নাম জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হকের (টুকু) ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নুরুল আমিন।

নুরুলের জন্য শামসুল হক তাঁর জাতীয় সংসদের প্যাডে একটি চিঠি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, প্রতিবছর পবিত্র হজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সরকারি দায়িত্ব পালনের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দলে দক্ষ কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। সে লক্ষ্যে কারিগরি দলে নুরুলকে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করেন তিনি।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলামও হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হয়ে সৌদি আরবে যেতে চান। এ জন্য তিনি প্রশাসনিক বা সহায়তাকারী দলে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে সরকারি খরচে হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হয়ে সৌদি আরবে যান। সে জন্য তিনিও এবার আবেদন করেছেন। নিজের প্রাসঙ্গিকতা না থাকার পরও কেন আবেদন করেছেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হজযাত্রীদের সেবা করা পুণ্যের কাজ। আমার এই পুণ্যের কাজে অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা ছিল।’

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এবার হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হিসেবে তিন শ্রেণিতে ৩০০ জনকে সৌদি আরবে পাঠানো হবে। এর মধ্যে প্রশাসনিক দলে ৫৫ জন, প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলে ৭৫ জন, চিকিৎসকসহ কারিগরি দলে ১৭০ জন থাকবেন। তাঁদের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করেছে মন্ত্রণালয়। গত বছর অবশ্য এই তিন শ্রেণিতে প্রায় ৬০০ জন সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। এবার এই সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরও অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তদবির করছেন, যাতে নিজের নাম তালিকায় ঢোকে। গত শনিবার সচিবালয়ে এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন ধর্মসচিব। সূত্র জানায়, বৈঠকে সচিব বলেন, নাম ঢোকাতে এখনো অনেকে তাঁকে ফোন দিচ্ছেন। তাঁর কাছে এক হাজারের বেশি ফোন এসেছে। এত ফোন এলে স্বাভাবিক কাজ করবেন কীভাবে।

হজযাত্রীদের সেবা করা পুণ্যের কাজ। আমার এই পুণ্যের কাজে অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা ছিল।’
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম

হজ ব্যবস্থাপনা দলের চূড়ান্ত তালিকায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংসদ সচিবালয়, বিভিন্ন কমিশন, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রয়েছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাঁরা যান, তাঁদের অনেকেই নিজের দায়িত্ব পালন করেন না। হজযাত্রীদের সেবা দেওয়া হয় মূলত কর্মচারীদের মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও সংস্থা থেকে কর্মকর্তারা প্রতিবছরই হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হন। এটা মূলত একটি অলিখিত কোটাব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।

কাজ কী

হজ ব্যবস্থাপনা দলের সদস্যদের কাজ কী, তা বলা হয়েছে সরকারি আদেশে। চিকিৎসক দলের দায়িত্ব চিকিৎসা দেওয়া। অন্যদের দায়িত্ব হজযাত্রীদের সেবা দেওয়া।

হজ প্রশাসনিক দলের একটি আদেশে বলা হয়, সদস্যদের দায়িত্ব হলো হজযাত্রীদের সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করা। তাঁরা নির্ধারিত পোশাক পরবেন এবং যেকোনো সময় দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকবেন। সরকারি–বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়া হজযাত্রীদের সেবা দিতে হবে। উল্লেখ্য, এবার সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হজযাত্রীদের সহায়তা দিতে যাঁরা সে দেশে যাবেন, তাঁরা হজ করতে পারবেন না।

সৌদি আরবের বাংলাদেশ হজ অফিস গত বছর অনুমতি ছাড়া ঘোরাঘুরি করায় কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছিল। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় খরচে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সৌদি যাওয়ার ‘মহোৎসব’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় বিরক্ত হয়েছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ডিসেম্বরে ধর্মসচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে শুধু ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে নিজস্ব জনবলকে হজ ব্যবস্থাপনার কাজে পাঠানো এবং হজ ব্যবস্থাপনায় যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের সৌদি আরবে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০২৩ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়া সরকারের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, হজযাত্রীদের সেবা দিতে কর্মকর্তাদের দেখা পাওয়া কঠিন। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সাধারণ হজযাত্রীদের সেবা করবেন, এটা তো আশা করাও যায় না। বরং তাঁদের সেবা দিতে ব্যস্ত থাকতে হয় কর্মচারীদের।

হজ কোটা খালি থাকার কারণ হিসেবে ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে সামনে আনা হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজে এবার ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯০ টাকা ও বিশেষ প্যাকেজে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজের ব্যয় ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা। তবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় একেক এজেন্সির প্যাকেজ ভিন্ন।

হজ ফ্লাইট শুরু ৯ মে

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১৬ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে হজ ফ্লাইট শুরু হবে ৯ মে। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের সৌদি আরবে হজ করতে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেতে পারবেন ১০ হাজার ১৯৮ জন, বাকিরা যাবেন বেসরকারিভাবে। যদিও কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও হজের কোটা পূরণ হয়নি। খালি আছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

রাষ্ট্রীয় খরচে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সৌদি যাওয়ার ‘মহোৎসব’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় বিরক্ত হয়েছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ডিসেম্বরে ধর্মসচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে শুধু ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে নিজস্ব জনবলকে হজ ব্যবস্থাপনার কাজে পাঠানো এবং হজ ব্যবস্থাপনায় যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের সৌদি আরবে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

হজ কোটা খালি থাকার কারণ হিসেবে ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে সামনে আনা হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজে এবার ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯০ টাকা ও বিশেষ প্যাকেজে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজের ব্যয় ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা। তবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় একেক এজেন্সির প্যাকেজ ভিন্ন।