বাংলাদেশজুড়ে কারফিউ সত্ত্বেও আন্দোলনে অংশ নিতে বাংলাদেশের পথে পথে ছাত্র–জনতার ঢল দেখেই শেখ হাসিনা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। গতকাল সোমবার সকালে সেনা ও নিরাপত্তা বিভাগের সবার সঙ্গে বৈঠকের পর হাসিনা ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলে ভারতের সংসদে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় দেওয়া ওই বিবৃতিতে জয়শঙ্কর বলেন, পদত্যাগ ও দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই হাসিনা স্বল্প সময়ের নোটিশে ভারতে আসার অনুমতি প্রার্থনা করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভারতে আসার ‘ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স’ চাওয়া হয়। শেখ হাসিনা সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লি পৌঁছেন।
পদত্যাগী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে এই তথ্যটুকু দেওয়া ছাড়া জয়শঙ্কর আর কিছু জানাননি। তিনি কীভাবে ভারতে এলেন, কত দিন থাকবেন, এখান থেকে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকছেন—সেসব বিষয়ে তিনি নির্বাক। সংগত কারণেই মনে করা হচ্ছে, নিরাপত্তার স্বার্থেই এই গোপনীয়তা।
জয়শঙ্কর বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার–উজ–জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করছেন।
জয়শঙ্করের এই বিবৃতিতে ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন, সেটিকে ঘিরে সহিংসতা, সরকারি স্থাপনা, অবকাঠামো, যানবাহন ও রেলসহ প্রভূত সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এত মৃত্যু নিয়ে একটি শব্দও নেই।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গোটা জুলাই মাস বাংলাদেশে সহিংসতা চলেছে। এ সময়ে ভারত সব সময় সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছে এবং বলেছে, একমাত্র আলোচনার মধ্য দিয়েই অশান্ত পরিস্থিতি শান্ত হতে পারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তাঁদের প্রত্যেককেই এই অনুরোধ করা হয়েছিল; কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২১ জুলাই বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় আসা সত্ত্বেও গণরোষ কমল না; বরং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলল। দাবি উঠে গেল একটাই—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে।
জয়শঙ্করের বিবৃতিতে বলা হয়, ৪ আগস্ট পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠে। থানা, পুলিশ আক্রান্ত হয়। সরকারি কার্যালয়ে হামলা হয়। সহিংসতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। দেশজুড়ে সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পত্তি আক্রান্ত হতে থাকে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিশেষ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে—সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ। কত সংখ্যালঘু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেই পূর্ণ চিত্র এখনো নেই।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন সেদিকটায় সরকার তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। বহু সংগঠন ও গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের রক্ষার বিষয়ে তৎপর বলে খবর এসেছে। তাঁদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। যদিও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ভারত উদ্বিগ্ন থাকবে। এই জটিল পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকতে সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশে ১৯ হাজারের মতো ভারতীয় নাগরিক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৯ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। অধিকাংশ শিক্ষার্থী জুলাই মাসেই দেশে ফিরে এসেছেন। ভারতের আশা, সেদেশে এখনো যাঁরা রয়েছেন, কর্তৃপক্ষ তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিকভাবে তাদের কাজ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিবৃতিতে জয়শঙ্কর বলেন, ঢাকায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় ভারত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
ভারতীয় রাজনীতির ঐতিহ্য ও বিশেষত্ব, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধীরা সচরাচর একই সুরে কথা বলে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দলীয় রাজনীতি করা হয় না। সংকটে দুই পক্ষই এক থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনই দেখা যাচ্ছে।
গতকাল সোমবার রাতে জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতিও দেন। আজ মঙ্গলবার সর্বদলীয় বৈঠকেও সেই ঐক্য দেখা যায়। ওই বৈঠকে রাহুল অবশ্য জানতে চান, বাংলাদেশের এই ঘটনাবলির পেছনে পাকিস্তানসহ বিদেশি শক্তির হাত আছে কি না।
জবাবে জয়শঙ্কর বলেছিলেন, বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের এক কূটনীতিক একাধিকবার তাঁর সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইলের ছবি বদলেছেন। সরকার দেখছে, এটা কোনো ইঙ্গিতবাহী কি না।