বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি ও নীতি প্রণয়নে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়া অনুদারতার পরিচায়ক।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্মরণে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক স্মরণসভায় আক্ষেপ প্রকাশ করে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক এসব কথা বলেন। তাঁরা আরও বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধু তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পর্যন্ত জানানো হয়নি।
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে গত ৮ মে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান। আজ রোববার বিআইডিএস তাদের কার্যালয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্মরণে একটি স্মরণসভার আয়োজন করে।
‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম: নানা প্রজন্মের দৃষ্টিতে দেখা’ শিরোনামের এই সভায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সহকর্মী, ছাত্র, অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালকসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেককে মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলে মন্দ হয় না।
একুশে পদক না পাওয়া নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বিনায়ক সেন বলেন, তিনি (নুরুল ইসলাম) উত্তরে বলেছিলেন, একুশে কেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক কিছু করেছেন। সেই স্বীকৃতিও তো পাননি।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান প্রমুখ।
মসিউর রহমান বলেন, একজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই মাপকাঠি হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। স্বীকৃতি না পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। সেটি হলো, দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকা এবং প্রাসঙ্গিকতা না থাকা।
স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাংকের বড় পদে যোগ না দিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান। স্মরণসভায় বক্তারা উল্লেখ করেন, পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সময় তাঁরা আমলাতন্ত্রের বাধার মুখে পড়েন। তিন বছরের মাথায় পদত্যাগ করার জন্য এক দফা তাঁরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তাঁদের পরিকল্পনা কমিশনে থেকে যেতে হয়।
পরে ১৯৭৫ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে ছুটি নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দেশের বাইরে যান। এর মধ্যে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। নুরুল ইসলামের আর দেশে ফেরা হয়নি।
স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, নুরুল ইসলাম মাঝেমধ্যে দেশে এসেছেন। কিন্তু সরকার কখনো তাঁকে কোনো বিষয়ে পরামর্শের জন্য ডাকেনি।
নুরুল ইসলামের সরাসরি ছাত্র মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, নুরুল ইসলাম ছিলেন কল্যাণ অর্থনীতিবিদ। তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল ছিল। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আপনি করে বলতেন। অনেক খাতির করতেন।
নুরুল ইসলাম কেন দেশে স্থায়ী হননি, তার কারণ তুলে ধরেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, নুরুল ইসলাম দেশে এলে খুব ভালো থাকতেন। তবে নিজের চিকিৎসা ও পরিবারের দেখাশোনার জন্য তিনি মনে করতেন তাঁর ফিরে যাওয়া উচিত।
বক্তব্যের শেষ দিকে নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘নুরুল ইসলামকে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকের মতো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দিলে ভালো হতো। আমরা তাঁকে সম্মানের বেদিতে বসাই। এটাই তাঁর বড় পুরস্কার।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের কোনো সরকার অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে তেমনভাবে স্মরণ করেনি। পরামর্শও চায়নি। বিশেষ কোনো জাতীয় স্বীকৃতি বা সম্মান দেওয়া হয়নি।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে একজন সেরা মানুষ, শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন না হতে পারার কোনো কারণ নুরুল ইসলামের ছিল না। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকবেন, নাকি পেশাদার অর্থনীতিবিদ হবেন, এই দ্বন্দ্ব তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ কারণে একজন বিশ্বমানের বাঙালি অর্থনীতিবিদ পাওয়া থেকে বিশ্ব বঞ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেন নুরুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নুরুল ইসলামের পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে তাঁকে বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল। ছয় দফা অনুসারে আওয়ামী লীগের ইশতেহার (১৯৭০) তৈরি, স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নীতি প্রণয়নে নুরুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সাধারণত অর্থনীতিবিদেরা একেকজন একেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন। তবে নুরুল ইসলাম ছিলেন পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ। তিনি শুধু গবেষণা করতেন না, সেটার প্রায়োগিক দিক নিয়েও কাজ করতেন। এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন সারা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম।
নুরুল ইসলাম ছাত্রদের প্রতি অপত্যস্নেহ পোষণ করতেন বলে উল্লেখ করেন তাঁর ছাত্র রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, রাজনীতি করার কারণে তাঁকে প্রায়ই জেলে যেতে হতো। একবার জেল থেকে বের হওয়ার পর অধ্যাপক নুরুল ইসলাম গিয়ে তাঁকে বলেন, ‘তুমি পরীক্ষা দেবে। যা পারো লিখবে। খাতা আমরা দেখব।’
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মেয়ে রুমিন রহমান কথা বলেন তাঁর বাবার আগ্রহের দিকগুলো নিয়ে। তিনি বলেন, নুরুল ইসলাম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের দিকে বেশি জোর দিতেন। কারণ, তিনি মনে করেন, সঠিক তথ্য-উপাত্ত ছাড়া নীতি নির্ধারণ করা যায় না। তিনি আরও বলেন, নুরুল ইসলাম ইতিহাস পাঠের ওপরও জোর দিতেন। কারণ, একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানা খুব জরুরি।
সবশেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পরিকল্পনা কমিশনে যেসব বাধা নুরুল ইসলামকে ব্যথিত করেছিল, তা এখনো আছে। স্বীকার করতেই হবে, পরিকল্পনা কমিশন সেই মর্যাদায় নেই। তিনি বলেন, ‘নুরুল ইসলামের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।’
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাবুদ্দিন, অর্থনীতিবিদ সাজ্জাদ জহির, আহমাদ আহসান প্রমুখ সরাসরি উপস্থিত হয়ে এবং অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ২৫টির মতো বই লিখেছেন। এর মধ্যে তাঁর আত্মজীবনী অ্যান ওডেসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ (২০১৭) প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমা থেকে নুরুল ইসলামের চারটি বই বেরিয়েছে। বাকি তিনটি হলো করাপশন, ইটস কন্ট্রোল অ্যান্ড ড্রাইভারস অব চেঞ্জ: দ্য কেস অব বাংলাদেশ (২০১৬); ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ: আ প্রাইমার অন পলিটিক্যাল হিস্ট্রি (২০১৯) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা (২০২০)।