আজ উদ্বোধন

যানজটের শহরে শুরু হচ্ছে মেট্রোরেলের যাত্রা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন। তাঁকে নিয়ে প্রথম ট্রেনটি চালাবেন এক নারী। গণপরিবহনে শুরু হবে নতুন যুগ।

দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে রাজধানীর উত্তরার উত্তর স্টেশন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল। গতকাল দুপুরে
ছবি: সাজিদ হোসেন

ঢাকার গণপরিবহন–ব্যবস্থায় নতুন একটি যুগ শুরু হচ্ছে আজ বুধবার। এদিন রাজধানীতে প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে মেট্রোরেল চলাচল শুরু করবে। যানজটে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী দেখবে ব্যস্ত সড়কের মধ্যে পিলার বসিয়ে তৈরি উড়ালপথে ছুটে চলছে ট্রেন। মাত্র ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে উত্তরা থেকে আগারগাঁও চলে আসছে মানুষ।

মেট্রোরেলের প্রথম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে। রাজধানীর জন্য তৈরি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) বলা হয়েছিল মেট্রোরেলের কথা। এরপর মাস গেছে, বছর গেছে, যুগ গেছে, মানুষের অপেক্ষা শুধু বেড়েছে। ২০১৬ সালে দেখা গেল, বেগম রোকেয়া সরণিতে সড়কের মাঝখানে কংক্রিটের ব্লকের বেড়া দিয়ে শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের কাজ। ছয় বছর পর মেট্রোরেল এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন। উত্তরায় এই আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ বেলা দুইটার দিকে দিয়াবাড়ি (উত্তরা) স্টেশন থেকে মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রী নিয়ে আগারগাঁওয়ের দিকে ছুটবে। প্রথম যাত্রার যাত্রী হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্য ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। সাধারণ যাত্রীরা অবশ্য মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে।

মেট্রোরেলের এই আনুষ্ঠানিক চলাচল বাংলাদেশে অনেক ‘প্রথমে’র জন্ম দেবে—এটি বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎ–চালিত ট্রেন, চলবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে; প্রথম যাত্রায় ট্রেনটি চালাবেন একজন নারী চালক, নাম মরিয়ম আফিজা এবং প্রথমবারের মতো যাত্রীরা ভাড়া পরিশোধ করবেন কার্ড দিয়ে। উড়ালপথের প্রথম ট্রেনও মেট্রোরেল।

রাজধানীর লক্কড়ঝক্কড় ও জীর্ণ বাসের বিপরীতে জাপানে তৈরি মেট্রোরেলের কোচগুলো অত্যাধুনিক। তিনতলা মেট্রোরেল স্টেশনে ওঠা–নামার জন্য সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়ি (এসকেলেটর) ও লিফট রয়েছে। ট্রেন ও স্টেশন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি)।

সব মিলিয়ে যাত্রীরা মেট্রোরেলে পাবেন আরামদায়ক ও দ্রুতগতির যাত্রার সুযোগ। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা, যেটা ঢাকায় অন্য কোনো পরিবহন দিতে পারবে না। বর্ষায় জলজটে বাস-অটোরিকশা আটকে থাকলেও মেট্রোরেল চলবে। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় অন্য সব যানবাহন থেমে থাকলেও মেট্রোরেল থামবে না। বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগমে ঢাকায় স্থবিরতা নেমে এলেও মানুষের সহজ যাতায়াতের মাধ্যম হবে মেট্রোরেল।

মেট্রোরেলের জন্য দিয়াবাড়ি ও মতিঝিল সাবস্টেশনে জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ–সংযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে বিকল্প সংযোগও। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হলে ট্রেন পরের স্টেশনে যাবে ব্যাটারির সাহায্যে। এই ট্রেন দুই দিকে চলতে পারে, ঘোরানোর প্রয়োজন হয় না।

উন্নত দেশগুলোতে বহু আগেই মেট্রোরেল চালু হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানেও আছে মেট্রোরেল। সেগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশেও মেট্রোরেল হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় গণপরিবহন।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। অর্থাৎ উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি পথে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে, যা লাইন-৬ নামে পরিচিত। এর মধ্যে আজ চালু হতে যাওয়া উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দূরত্ব পৌনে ১২ কিলোমিটার।

মেট্রোরেল চালুর আগের দিন গতকাল মঙ্গলবার আগারগাঁও স্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী বছর ডিসেম্বরে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হবে। কমলাপুর পর্যন্ত চালু হতে সময় লাগবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। পুরোটা চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দৈনিক ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। এই পথ যেতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট।

এই পথ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করবেন যাত্রীরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেল স্টেশনে

শুরুতে সীমিত চলাচল

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ উদ্বোধনের পর মেট্রোরেল চলাচল করবে সীমিতভাবে। আগামী ২৬ মার্চ থেকে উত্তরা-আগারগাঁও পথে পুরোদমে যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে মেট্রোরেল। উত্তরা আগারগাঁও পথের জন্য ৬ কোচবিশিষ্ট ১০টি ট্রেন প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো প্রথম তিন মাস মেট্রোরেল মাঝের কোনো স্টেশনে থামবে না। ১০ মিনিট পর পর ট্রেন যাত্রা শুরু করবে। দিনে চলবে ৪ ঘণ্টা—সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। প্রতিটি ট্রেন সর্বোচ্চ ২০০ যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। সপ্তাহে এক দিন মঙ্গলবার ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। অবশ্য টিকিট কাটা, ওঠানামা ও চলাচলে মানুষের অভ্যস্ততা তৈরি হলে ঘন ঘন ট্রেন চলবে, সব স্টেশনে থামবে এবং যাত্রীও বেশি নেওয়া হবে।

ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা বলছেন, অভ্যস্ততা তৈরির পর নির্ধারিত সময় কমিয়ে আনা হতে পারে। মেট্রোরেলের মূল পরিকল্পনায় প্রতি সাড়ে তিন মিনিট অন্তর ট্রেন চলার কথা। মাঝের স্টেশনে যাত্রাবিরতির সময় হবে ৩০ সেকেন্ড।

ভিড় বেশি হলে একটি ট্রেন কত যাত্রী নিতে পারবে, তার একটি হিসাবও আছে। ডিএমটিসিএল বলছে, একেকটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। বসার ব্যবস্থা রয়েছে ৩০৬ জনের। ট্রেনের সাড়ে ৯ ফুট চওড়া কোচের দুই পাশে আসন থাকবে। মাঝে প্রশস্ত জায়গায় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন।

টিকিট মানে কার্ড

মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশনে গিয়ে গতকাল দেখা যায়, দুই প্রান্তে চারটি টিকিট কাউন্টার পুরোপুরি প্রস্তুত। বৃহস্পতিবার থেকে এই কাউন্টারে কর্মীদের টাকা দিলে টিকিট অর্থাৎ র‌্যাপিড কার্ড পাওয়া যাবে। কার্ড ছোঁয়ালে খুলবে স্টেশনের তৃতীয় তলায় যাওয়ার পথ। সেখানে গিয়ে ট্রেনে চড়া যাবে।

মেট্রোরেলে ভ্রমণের জন্য দুই ধরনের টিকিট রাখা হয়েছে—১০ বছরের স্থায়ী কার্ড ও এক যাত্রার (সিঙ্গেল জার্নি) কার্ড। স্থায়ী কার্ডের জন্য লাগবে ২০০ টাকা, যা নিরাপত্তা জামানত। এই কার্ডে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনমতো টাকা ভরতে (রিচার্জ) হবে। কেউ কার্ড ফেরত দিলে জামানত ফেরত পাবেন। হারিয়ে ফেললে টাকা দিয়ে নতুন করে কার্ড কিনতে হবে। এতে পুরোনো কার্ডে টাকা থাকলে তা অবশ্য নতুন কার্ডে যুক্ত হবে।

স্থায়ী কার্ড কেনার আগে নিবন্ধন করতে হবে। এর জন্য নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) লাগবে। পাসপোর্টের নম্বর হলেও চলবে। এসব তথ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্যভান্ডারের সঙ্গে মিলতে হবে। নইলে কার্ড পাওয়া যাবে না। স্থায়ী কার্ড নিজের কাছেই থাকবে। একক যাত্রার কার্ড ভ্রমণ শেষে যন্ত্রের ভেতরে দিলে তবেই বের হওয়ার পথ খুলবে।

স্টেশনে টিকিট দিতে যেমন মেট্রোরেলের কর্মীরা থাকবেন, তেমনি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রও আছে। এতে টাকা দিলে একক যাত্রার টিকিট বের হয়ে আসবে।

ট্রেনের যাত্রীরা একদিকের দরজা দিয়ে উঠবেন এবং নামবেন অন্যদিক দিয়ে। শেষ স্টেশনে সব যাত্রীকে নেমে যেতে হবে। অর্থাৎ কেউ ট্রেনে অবস্থান করতে পারবেন না। নতুন করে কার্ড ছুঁইয়ে (পাঞ্চ করে) ট্রেনে উঠতে হবে। প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্মে দরজাযুক্ত বেড়া আছে। স্টেশনে এসে ট্রেনের দরজা বেড়ার দরজা বরাবর খুলে যাবে। এরপর যাত্রীরা ট্রেনে উঠতে–নামতে পারবেন।

মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা। স্থায়ী কার্ড কিনে যাতায়াত করলে ১০ শতাংশ ছাড় আছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিনা মূল্যে যাতায়াত করতে পারবেন। পঙ্গুদের জন্য ছাড় আছে ১৫ শতাংশ। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া বা হাফ পাসের ব্যবস্থা নেই, যেটা বাসে রয়েছে।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, মেট্রোরেলে খরচের তুলনায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভাড়া কম ধরা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ছাড় থাকছে না। তিনি জানান, কোনো পরিবারের সঙ্গে তিন ফুটের চেয়ে কম উচ্চতার শিশু থাকলে তার ভাড়া দিতে হবে না।

বাধা কাটিয়ে মেট্রোরেল

২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় মেট্রোরেলের কথা বলা হলেও সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ২০০৮ সালে। ২০১২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মেট্রোরেল লাইন-৬ (উত্তরা থেকে কমলাপুর) নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন পায়। কিন্তু বিজয় সরণি অংশে মেট্রোরেল কোন পথ দিয়ে যাবে, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। প্রথমে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের সামনে দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার কথা ছিল। সেটা নিয়ে বিমানবাহিনী আপত্তি জানায়। পরে পথ পরিবর্তন করে মেট্রোরেল জাতীয় সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে ফার্মগেটে নেওয়া হয়।

মেট্রোরেল নির্মাণে কারিগরি ও ঋণসহায়তা দিয়েছে জাপান। দেশটির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ঋণ চুক্তি করে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। একই বছর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় মেট্রোরেলের সাত পরামর্শক নিহত হন। এরপর কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে মেট্রোরেলের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ দেওয়া হয়। কাজ শুরু হয় আবার। কিন্তু করোনা মহামারিতে নির্মাণকাজ বিঘ্নিত হয়।

শেষ দিকে কাজ হয়েছে দ্রুত। এখন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নির্মাণ যেমন শেষ, তেমনি আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উড়ালসড়ক তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ।

ঢাকায় আরও পাঁচ পথে মেট্রোরেল

মেট্রোরেল উত্তরা-কমলাপুর পথেই হচ্ছে না, ঢাকা ও এর আশপাশের উপশহরগুলোকে সচল রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পাতালপথে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ আগামী জুনেই শুরু করার কথা রয়েছে।

পাঁচটি মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ তিন পর্বে বাস্তবায়িত হবে। জাইকার সমীক্ষা অনুসারে, উত্তরা-মতিঝিলের চলমান মেট্রোরেলসহ ছয়টি মেট্রোরেল নির্মিত হলে দৈনিক প্রায় ৫২ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যানজটের এই শহরে মানুষকে মুক্তি দেবে মেট্রোরেল, যার সূচনা হবে আজ।