রংপুরের মিঠাপুকুরে ধর্ষণের অভিযোগে করা এক মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে পিতৃপরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়া শিশুটিকে নতুনভাবে দানপত্রের মাধ্যমে ৩৮ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে তার বাবাকে বলেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
যে দানপত্রের মাধ্যমে ২৫ ও ১৫ শতাংশ জমি শিশুটিকে রেজিস্ট্রি দলিলমূলে দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল ও সংশোধন করে কয়েকটি শর্তে নতুন করে দানপত্র করতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, শিশুটির পক্ষে এই দান গ্রহণ ও দখল বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার বাবার পরিবর্তে তার মায়ের নাম উল্লেখ করতে হবে।
শিশুটির বয়স এখন ১৫ বছর; তার মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। ওই মামলায় ছয় বছর আগে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ে আসামি মো. আসাদুলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়, আসাদুল শিশুটির জৈবিক পিতা বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হলো। বিচারিক আদালতের দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ২০১৮ সালে আপিল করেন আসাদুল। পরবর্তীকালে তিনি জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। এ শুনানিতে শিশুসন্তানের দায়ভার গ্রহণ করতে আসাদুল ইচ্ছুক বলে জানান তাঁর আইনজীবী। শুনানিতে শিশুটির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপিলকারী কী দায়দায়িত্ব পালন করবেন, সে বিষয়ে নির্দেশনার প্রসঙ্গও ওঠে।
শুনানি নিয়ে গত ২১ জানুয়ারি হাইকোর্ট আসাদুলকে দুই মাসের জামিন দেন। পাশাপাশি শিশুটিসহ উভয় পক্ষকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জামিনে মুক্তি পেয়ে গত ২০ মার্চ শিশুটির বাবা আসাদুল এবং মা ও নানার সঙ্গে শিশুটি আদালতে হাজির হয়। আসাদুল তাঁর বাবার কাছ থেকে যে সম্পত্তি পাবেন, তার অর্ধেক সম্পত্তি শিশুটিকে রেজিস্ট্র দলিলমূলে হস্তান্তর করতে আদেশ দেন আদালত। পরবর্তীকালে আপস-নিষ্পত্তির জন্য আসামিপক্ষের আইনজীবী সময় চাইলে আদালত ৫ জুন পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
আগের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার বিষয়টি ওঠে। শুনানির সময় শিশুটি ও তার মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আদালতে আসাদুলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মাহফুজ উল আলম। ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রফিকুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান (লিখন)। শুনানি নিয়ে আদালত আদেশ দেন।
ঘটনাক্রম উল্লেখ করে আদেশে বলা হয়, আপিলকারী পক্ষ (শিশুটির বাবা) দানপত্রের অনুলিপি যুক্ত করে জানান, শিশুটির অনূকূলে ২৫ ও ১৩ শতাংশ জমি দানপত্রের মাধ্যমে রেজিস্ট্রিমূলে হস্তান্তর করেন। নাবালকের (শিশুটির) পক্ষে তার বাবা (আসাদুল) অভিভাবক হিসেবে দখল বুঝে নেন। ভুক্তভোগী পক্ষ (শিশুটির মা) থেকে জানানো হয়, ২৫ শতাংশ সম্পত্তি নিয়ে বাঁটোয়ারা মামলা বিদ্যমান, যা দণ্ডিত আপিলকারীর পক্ষের আইনজীবী স্বীকার করেন। সে ক্ষেত্রে একজন নাবালককে আদালতে বিচারাধীন মামলা–সম্পর্কিত সম্পত্তি দান করার বিষয়টি স্বচ্ছতার দাবি রাখে না, বরং তা প্রতারণার শামিল। ভবিষ্যতে দানের উদ্দশ্য ব্যাহত হবে এবং দানগ্রহীতাকে ভবিষ্যৎ মামলা–মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়তে হবে। সে ক্ষেত্রে যে তারিখের দানপত্র শিশুটির বরাবর রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল ও সংশোধন করে নতুনভাবে কয়েকটি শর্তে আরেকটি দানপত্র সম্পাদন করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
শর্তে আদালত বলেছেন, নতুন দানপত্রে তফসিলে উল্লেখিত যে ২৫ শতাংশ সম্পত্তি নিয়ে বাঁটোয়ারা মামলা আছে, তা বাদ দিয়ে নতুন করে নিষ্কণ্টক সম্পত্তি দিতে হবে। নাবালকের পক্ষে দান গ্রহণ ও দখল বুঝিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার বাবার পরিবর্তে তার মায়ের নাম উল্লেখ করতে হবে। দান করা সম্পত্তির দখল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও তহসিলদারের উপস্থিতিতে দখল বুঝিয়ে দিতে হবে।
এ–সংক্রান্ত দলিলের কপি আদালতে দাখিল করতে হবে বলে আদেশে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। আদেশে বলা হয়, এ আদেশ প্রতিপালনের বিষয়ে হলফনামা আগামী ৭ জুলাই আদালতে দাখিল করতে বলা হলো। শিশুটি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এই সম্পত্তি কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য হবে না। হস্তান্তর দলিলের মন্তব্যের ঘরে (৭ নম্বর কলাম) লিখতে হবে, আদালতের নির্দেশে দানপত্র দলিল সম্পাদিত হচ্ছে।
আদেশের পর ভুক্তভোগী নারীর আইনজীবী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি এখন তার মায়ের সঙ্গে নানাবাড়িতে থাকে।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, ধর্ষণের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২১ নভেম্বর মিঠাপুকুর থানায় মো. আসাদুলসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী, যিনি তখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মামলা করার পর ভুক্তভোগী ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। মামলার বিচারের সময় শিশুটির ডিএনএ পরীক্ষা হয়। ২০১০ সালের ৭ মার্চের ডিএনএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুক্তভোগী নারী শিশুটির জৈবিক মাতা ও আসামি মো. আসাদুল শিশুটির জৈবিক পিতা।
ওই মামলায় ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল রায় দেন রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে আসাদুলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বলা হয়, মো. আসাদুল শিশুটির জৈবিক পিতা বলে সিদ্ধান্ত হলো। ভুক্তভোগীর সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় তার ২১ বছর বয়স পর্যন্ত বিধি অনুসারে রাষ্ট্র বহন করবে। সরকার প্রয়োজন মনে করলে ওই অর্থ বিধি অনুসারে আসামির কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারবে।