‘ন্যায্য নগরজীবনের অধিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা নগরজীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও এর প্রতিকার নিয়ে কথা বলেন। ঢাকা, ১৯ নভেম্বর
‘ন্যায্য নগরজীবনের অধিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা নগরজীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও এর প্রতিকার নিয়ে কথা বলেন। ঢাকা, ১৯ নভেম্বর

আলোচনা সভায় অভিমত

নগরকে বাসযোগ্য করতে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন

বাসযোগ্য শহরের বৈশ্বিক তালিকায় তলানিতে অবস্থান ঢাকার। আবাসন–সংকট, যানজট, বায়ু–শব্দদূষণ, পানি–পয়োনিষ্কান সমস্যাসহ সংকটের যেন শেষ নেই। অন্যান্য শহরেও একই ধরনের সংকট বাড়ছে। এতে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। প্রশাসন ও উন্নয়নকে বিকেন্দ্রীকরণ না করতে পারলে নগরকে বাসযোগ্য করা সম্ভব নয়। তবে কোনো গোষ্ঠী নয়, নাগরিকদেরই ঠিক করতে হবে তাঁরা কেমন নগর চান।

‘ন্যায্য নগরজীবনের অধিকার’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় পরিবেশবিদ, নগর–পরিকল্পনাবিদ, নগরের বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কথায় এ অভিমত উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। সহ–আয়োজক হিসেবে ছিল পিআইবি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), মিশন গ্রিন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান। ঢাকা, ১৯ নভেম্বর

দিনব্যাপী এই আয়োজনের প্রথম ভাগে ছিল দুটি অধিবেশ। প্রথম অধিবেশনে আলোচনা হয় ন্যায্য নগর ইশতেহার বিষয়ে। দিনব্যাপী এই আয়োজনের উদ্বোধন করেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান। মেয়রের কার্যালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পেছনে সিন্ডিকেট কীভাবে কাজ করে, সেটা বুঝতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

নগরকে বসবাসের অযোগ্য করে রাখা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, আমলাতন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের চক্র পরিকল্পনাবিদেরা একা ভাঙতে পারবেন না। এতে গণমানুষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। গণমানুষই ঠিক করুক, তাদের নগরটা কেমন হবে।
আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোশতাক খান বলেন, রাজউকের আইন খারাপ নয়। কিন্তু কোনো অনুমতি চাইলে ওই সিন্ডিকেটের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। রাজউক হোক, রাজনীতি হোক, ব্যবসা হোক—বুঝতে হবে ক্ষমতাকাঠামো কীভাবে নিয়মকানুনগুলো মানছে বা ভাঙছে।

বাস্তবমুখী ইশতেহার চাইলে দুটি কাজ করতে হবে বলে মনে করেন মোশতাক খান। তিনি বলেন, প্রথমত, বিকল্প ক্ষমতাসীন সংগঠন বা নতুন শক্তি গঠন করতে হবে, যারা ওই সিন্ডিকেট বা পুরোনো শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাকাঠামো আগেরটাই রেখে কিছু আইনের পরিবর্তন করলে আরও অনেক লোক লাভবান হবেন।

নগরজীবনে ভোগান্তি নিয়ে কথা বলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী। ঢাকা, ১৯ নভেম্বর

নগরজীবনে মানুষ অনেক ভোগান্তিতে রয়েছেন বলে উল্লেখ করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী। চাঁদাবাজির মাধ্যমে রাজনীতিতে অর্থায়ন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনীতিতে অর্থায়নের বিকল্প তৈরি করতে হবে। চাঁদাবাজির কারণে ফুটপাত থেকে দোকানপাট উচ্ছেদ করে হাঁটার ব্যবস্থা করা যায় না বলেও উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন।

প্রথম অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পুরান ঢাকার কসাইটুলি পঞ্চায়েত এম আবু হুরায়রা। সমতার ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা গড়ে না তুললে সেখানে প্রতিবাদ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেট্রোরেল পুরান ঢাকায় নেওয়া হয়নি। এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধাও পুরান ঢাকার বাসিন্দারা পান না। এসব নিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।

মেট্রোরেলে নারীদের জন্য আলাদা বগি রাখলে কিংবা আলাদা বাসের ব্যবস্থা করলে শহর ন্যায্য হবে না। শহরটা তখনই ন্যায্য হবে, যখন নারীরা পুরুষদের পাশে বসতে পারবে। পুরুষের পাশে বসলে ভয় লাগবে না।
শাফিনাজ সামিন, অধ্যাপক, এমআইএসটি

ঢাকায় বহুমুখী পরিবহনের ব্যবস্থা দরকার উল্লেখ করে আবু হুরায়রা বলেন, ঢাকায় নদীপথকে ব্যবহার করা হয় না। ট্রেনের ব্যবহারও কম।

ঢাকা শহরে আলোর ভয়াবহ দূষণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন শিল্পী অরূপ রাহী।

অন্যায্য রাষ্ট্রে ন্যায্য নগর আশা করা যায় না বলে মন্তব্য করেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান।

অধিবেশনে বক্তব্য দেন পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। ঢাকা, ১৯ নভেম্বর

প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। এ অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রোম, যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইফাদুল হক ও সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ।

‘গণমানুষই ঠিক করুক নগর কেমন হবে’

দিনের প্রথম ভাগের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘নিরাপদ জীবন ও বাসযোগ্য শহর’ বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি মনে করেন, গণ–আন্দোলন ছাড়া ন্যায্য শহর তৈরি করা যাবে না।

গণ–অভ্যুত্থানের পর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও রাজধানীর ধানমন্ডির ৮ নম্বর খেলার মাঠসহ বিভিন্ন মাঠ, পার্ক দখলে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রতিটি মাঠ, পার্ক উদ্ধার করে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।

শুধু রাজনীতি নয়, ন্যায্য নগর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তরুণদের প্রয়োজন উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নগরকে বসবাসের অযোগ্য করে রাখা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, আমলাতন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের চক্র পরিকল্পনাবিদেরা একা ভাঙতে পারবেন না। এতে গণমানুষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। গণমানুষই ঠিক করুক, তাদের নগরটা কেমন হবে। এটা শুধু কোনো গোষ্ঠী যেন ঠিক করতে না পারে।

বিনা মূল্যে নগরের বিভিন্ন জায়গায় শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের মতো নগরের বিভিন্ন জনপরিসরে বিনা মূল্যে পানি পানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবেন। পাশাপাশি বোতলজাত পানির ব্যবহারও কমবে, যা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাবে।

নারীদের জন্য শহর ন্যায্য হবে কখন—সেই প্রশ্ন তোলেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) অধ্যাপক শাফিনাজ সামিন। মেট্রোরেলে নারীদের জন্য আলাদা বগি রাখলে কিংবা আলাদা বাসের ব্যবস্থা করলে শহর ন্যায্য হবে না বলে মনে করেন তিনি। শাফিনাজ সামিন বলেন, শহরটা তখনই ন্যায্য হবে, যখন নারীরা পুরুষদের পাশে বসতে পারবে। পুরুষের পাশে বসলে ভয় লাগবে না। পুরুষ ও নারী—উভয়ই পরস্পরকে মানুষ হিসেবে দেখবে।

বাসযোগ্য শহরের তলানিতে ঢাকা অবস্থান করছে উল্লেখ করে বাপার যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর রসুল বলেন, ঢাকাসহ দেশের সব শহর দূষণের নগরীতে পরিণত হচ্ছে।
যানজট, পরিবেশদূষণ, আবাসন—এসব বিষয়ের উন্নয়নে ইতিবাচক অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন আমিনুর রসুল। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে দুই কোটির বেশি মানুষ আছে। রাষ্ট্র সবাইকে আবাসন দিতে পারছে না, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে পারছে না। পানি ও বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সবকিছুর খারাপ অবস্থা। প্রশাসন ও উন্নয়নের বিষয়গুলোর সমন্বয় ও বিকেন্দ্রীকরণ না করতে পারলে এসব সমস্যার সমাধান হবে না।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিল্পী রায় প্রমুখ।