কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন একটি সমাবেশের বক্তারা। তাঁরা বলেছেন, সরকারের তরফে যেসব বক্তব্য আসছে তাতে মনে হচ্ছে, হত্যার শিকার হয়েছে কেবল স্থাপনা, মানুষের প্রাণহানি হয়নি। তাই তথ্য গোপন না করে নাগরিকদের মতপ্রকাশ ও তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে এ সমাবেশ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীরা সেখানে বক্তব্য দেন।
সমাবেশে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ডের জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত চাই। প্রতিটি গুলিবিদ্ধ দেহের বিপরীতে জবাব চাই।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ, ছাত্রদল কাদের সৃষ্টি? এই নষ্ট রাজনীতি বন্ধ চাই। সব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। আর একটা গুলিও যেন না হয়।’
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, ‘আমরা নাকি সিঙ্গাপুর হয়ে গিয়েছি! সিঙ্গাপুর হলে এতগুলো লাশের পর সে দেশের কতজন মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন? আমাদের দেশে কি ঘটেছে? এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আপনাদের ক্ষমা চাইতে হবে। আমরা ভালো নেই।’
সমাবেশে বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, হত্যার শিকার হয়েছে কেবল স্থাপনা, মানুষের প্রাণহানি হয়নি।’ এই আন্দোলন ঘিরে যাঁদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের তথ্য প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি না করা যায়, তাহলে আমরা কোনো দিন স্বৈরশাসকের হাত থেকে বের হতে পারব না।’
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের ওপর গুলি চলেছে, কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু সরকারের বক্তব্য শুনে মনে হবে, শুধু রাষ্ট্রের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।’ এই সমাবেশ করতেও অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশে তথ্য গোপন করা হচ্ছে; কিন্তু আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য জানতে চাই। সেই অধিকার আমাদের আছে।’
সাংবাদিক আবু সাইদ খান বলেন, দুই শতাধিক প্রাণ ঝরে গেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদও ধ্বংস হয়েছে। এই আন্দোলন শুধু কোটাবিরোধী নেই। এটা জনগণের আন্দোলন হয়ে উঠেছে।
সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিবর্তনের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান (লালটু), সাংবাদিক আশরাফ কায়সারসহ অনেকে।
এই কর্মসূচির ব্যানারে লেখা ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন, ‘স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবোই’। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিবাদী গান গেয়ে আর কবিতা পড়ে প্রতিবাদ জানান শিল্পী ও সমাজকর্মীরা। স্লোগান দিয়ে তাঁরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’, ‘এই শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গেয়ে গেয়ে প্রতিবাদ জানান সবাই। শিল্পী সায়ান গান ‘ভয় বাংলায়, ভয় বাংলায়/ এই বাংলা নাকি তাদের আর অন্য কারও নয়, জয় ক্ষমতার জয় ক্ষমতার’ গান গাওয়া হয়।
সমাবেশ শেষে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে চাইলে নিরাপত্তার কারণে তা বাতিল করা হয়। সমগীত, বটতলা, বিবর্তন, চারণ শিল্পীগোষ্ঠী, উত্তরসূরিসহ দেশের মোট ৩১টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা এ সমাবেশে অংশ নেন। সমাবেশ শুরুর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের কাছ থেকে মাইক নিয়ে গেছেন বলে জানান সংস্কৃতিকর্মীরা।