বেশি ওজনের ব্রাহমা গরু পালনের কয়েকটি প্রকল্পে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কয়েক দফায় কোটি টাকা খরচ করেছে। তবে ছয় বছর ধরে ব্রাহমা গরু পালনের কাজ সরকারি পর্যায়ে বন্ধ বললেই চলে। আর বেসরকারি পর্যায়ে এই গরু আমদানি ও প্রজননে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অধিদপ্তর।
ব্রাহমার উৎপত্তি ভারতে। পরে যুক্তরাষ্ট্রে আরও দুই থেকে তিনটি জাতের সংমিশ্রণে এটিকে উন্নত করা হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দুই থেকে আড়াই বছরের দেশি গরুর ওজন যেখানে ২৫০ থেকে ৩৫০ কেজি, সেখানে ব্রাহমা জাতের গরুর ওজন হয় ৮০০ থেকে ১০০০ কেজি পর্যন্ত।
২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্রাহমা গরু পালনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রকল্পে কয়েক দফায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে। এরপর থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গরু পালন ও আমদানি হয়নি। তবে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি ব্রাহমা গরু আমদানি করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান । প্রথমে বাজেয়াপ্ত ও পরে সেটি খালাস করা হয়।
কয়েক বছর ধরেই দেশে গরুর মাংসের দাম বাড়ছে। এখন গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকার ওপরে। এই দাম অনেকের নাগালের বাইরে।
এমন বাস্তবতায় মাংসের চাহিদা পূরণে কেন ব্রাহমা বেসরকারি পর্যায়ে নিষিদ্ধ রয়েছে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (কৃত্রিম প্রজনন দপ্তর) আনন্দ কুমার অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রাহমা জাতের গরু বেশি মাংস দিলেও দুধ একেবারেই কম দেয়। মানুষ ব্রাহমার প্রতি ঝুঁকে পড়লে দেশে দুধ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারে।’ ফ্রিজিয়ানা জাতের গরুতে দুধ ও মাংস দুটিই বেশি পাওয়া যায়। তাই দুধও দেবে, মাংসও দেবে এমন জাতের গরু চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও জানান আনন্দ কুমার অধিকারী।
বেসরকারি পর্যায়ে কৃত্রিম প্রজননের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন ও পরামর্শ দেওয়ার কাজ করে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রেগুলেটরি কমিটি (এনটিআরসি)। সংস্থাটি নির্বাচিত কিছু এলাকায় ব্রাহমা জাতের গরুর উৎপাদনের পক্ষে। তবে তাতে সায় নেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের।
ব্রাহমা জাতের গরু বেশি মাংস দিলেও দুধ একেবারেই কম দেয়। মানুষ ব্রাহমার প্রতি ঝুঁকে পড়লে দেশে দুধ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারেপ্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (কৃত্রিম প্রজনন দপ্তর) আনন্দ কুমার অধিকারী
২০০৮ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রাহমা উৎপাদন কর্মসূচি শুরু হয়। প্রকল্পের নথি সূত্রে জানা যায়, পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ১১টি উপজেলায় ৩ বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পের কাজ চলে।
বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প ২০১৩ সালের ১৮ জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ওঠে।
ওই বছরের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন মেয়াদে ২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে ব্যয়ও বাড়িয়ে করা হয় ৩২ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্পের ওপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ব্রাহমা জাতের মাংসাল গরু পালনে খামারিদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং এই খাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
ফলে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকার সমস্যার সমাধান সহজতর হবে। তবে মূল্যায়ন ইতিবাচক হলেও সরকারিভাবে ব্রাহমা গরু পালন প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একটি নীতিমালার আওতায় বেসরকারি পর্যায়ে ব্রাহমার কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগও বন্ধ রাখে।
এ বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কয়েকটি ধাপে ব্রাহমা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এখন টাকা খাওয়া শেষ দেখেই কি তাঁরা বলছেন, ব্রাহমা লাগবে না?
প্রকল্পটি চলমান অবস্থায় ‘বেসরকারি পর্যায়ে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার সংশোধিত নীতিমালা-২০১৬’ প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিমালার ৩–এর–১১ নম্বর ধারায় বলা আছে, বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সরকারকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে এ ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনার আপাতত কোনো সুযোগ নেই।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালার ৩–এর–১১ নম্বর ধারা এখনো বলবৎ রয়েছে। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে ব্রাহমা আমদানি, প্রজনন ও লালন–পালনের কোনো সুযোগ নেই। তবে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি ব্রাহমা গরু আমদানি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেইরি সান প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথমে বাজেয়াপ্ত ও পরে সেটি খালাস করা হয়।
ওই বছরের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন মেয়াদে ২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে ব্যয়ও বাড়িয়ে করা হয় ৩২ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
ডেইরি সান প্রাইভেট লিমিটেড ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হলস্টিন ফ্রিজিয়ান গরুর অনুমতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি ব্রাহমা গরু আমদানি করে। তারপর গরুগুলো বিমানবন্দরে আটকে রেখে সাময়িকভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখা হয়।
আমদানিকারক বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে যান। হাইকোর্ট ‘আমদানি নিষিদ্ধ নয়’ বলে আদেশ দেন। পণ্য চালানটি বাজেয়াপ্ত করার বদলে ৩৫ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা আদায় করে তা খালাস করে দেয় ঢাকার কাস্টম হাউস।
২০১৮ সালের ২৩ জুলাইয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি অফিস আদেশ জারি করেছিল। তাতে বলা হয়, ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রেগুলেটরি কমিটির (এনটিআরসি) সুপারিশ অনুযায়ী গবাদিপশু আমদানির ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনাপত্তি গ্রহণ করে তা করতে হবে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। কোর্টের কাছে তারা সঠিক তথ্য দেয়নি। যে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর এর কনসার্ন, তাদের পক্ষ না করে আদালত থেকে একটি ডাইরেকশন নিয়ে গিয়েছিল। তারা (আমদানিকারক) কিছুটা কোর্টের ওপর ফ্রট প্র্যাকটিস করে নিয়ে গেছে। এর পরবর্তী সময় আবার কিছু গরু যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে। সেগুলোকে কাস্টম বাজেয়াপ্ত করেছে। সেগুলোকে জব্দ করে এখনো রাখা আছে।’
ডেইরি সানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদিত হয় সিরাজগঞ্জে। একইভাবে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা মাংসের গরু তৈরির রাজধানী। ওই অঞ্চলের মানুষ দুধের গরু চায় না। এসব জায়গায় ব্রাহমার উৎপাদন করা যেতে পারে।বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত একটি সভায় এনটিআরসি বলেছিল, এই মুহূর্তে গ্রামগঞ্জে ব্রাহমা জাতের গরুর বীজ অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না। দুগ্ধ উৎপাদনকারী পকেট এলাকাগুলোয় ব্রাহমা জাতের ষাঁড়ের বীজ ব্যবহার বন্ধ রাখা প্রয়োজন। যেসব এলাকায় দুধ উৎপাদন কম হয় বা দুধেল গাভি পালনে আগ্রহ কম এবং খামারিরা হৃষ্টপুষ্টকরণে আগ্রহী, সেসব এলাকাগুলোয় ব্রাহমা জাতের বীজ দেওয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমাদের দুধের ভালো জাত দরকার, মাংসেরও ভালো জাত দরকার। যেহেতু আমাদের দেশে মাংসের চাহিদা অনেক বেশি। তা ছাড়া দেশের যেসব অঞ্চলে দুধের গাভি ভালো হয় না, গরম বেশি, ঘাসের জোগান কম; সেসব অঞ্চলের ব্রাহমা ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন এই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদিত হয় সিরাজগঞ্জে। একইভাবে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা মাংসের গরু তৈরির রাজধানী। ওই অঞ্চলের মানুষ দুধের গরু চায় না। এসব জায়গায় ব্রাহমার উৎপাদন করা যেতে পারে।’ দেশে পোলট্রি না থাকলে গরিব মানুষ মুরগির স্বাদ গ্রহণ করতে পারত না। একইভাবে সাধারণ মানুষের জন্য কম দামি গরুর গোশত দরকার, যা ব্রাহমার মাধ্যমে করা সম্ভব বলেও মনে করেন মোহাম্মদ ইমরান হোসেন।
তবে ইমরানের সঙ্গে একমত নন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা। তিনি এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাংসের কথা বিবেচনা করে ব্রাহমা আমদানি, প্রজনন ও লালন–পালনের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি এখনো ভাবছি না।’
ব্রাহমার মাংস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় বলছেন প্রাণিবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আবু হাদী নূর আলী খান। তবে এ নিয়ে আরও গবেষণা দরকার বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘গরুতেও অনেক রোগজীবাণু থাকে। প্রকাশ পেতে ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। এ জন্য গবেষণা করা ছাড়া ব্রাহমা দেশে আনা উচিত হবে না।’ ব্যবসায়ীরা ব্রাহমা গরু আনলে গ্রামে দেশি গরুর লালন–পালনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন এই প্রাণিবিশেষজ্ঞ।