জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসনে আবারও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এবার যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া উপসচিব পদে পদোন্নতি নিয়েও আলোচনা আছে। এই পদে পদোন্নতি হতে আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে।
জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে পদোন্নতি দিলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি কাজ করবে। সরকার বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্বাচনের আগে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে।
যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়টি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন নিশ্চিত করেছেন। গত ৩০ জুলাই সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে কিছুদিন আগে ডিসি নিয়োগের কথা তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যাঁদের (ডিসি পদ থেকে) তুলে আনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২০ জন বিসিএস ২২তম ব্যাচের (চাকরিতে যোগদান ২০০৩ সালে) কর্মকর্তা। আশা করা যাচ্ছে, তাঁরা শিগগির যুগ্ম সচিব হয়ে যাবেন। ইতিমধ্যে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের সভা শেষ হয়েছে। এ জন্যই তাঁদের উঠিয়ে আনা হয়েছে এবং তাঁদের জায়গায় নতুনদের পদায়ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ডিসির পদটি উপসচিব পদমর্যাদার।
নির্বাচন এলেই ক্ষমতাসীনেরা এভাবে পদোন্নতি দেয়। ২০১৩ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে এভাবে পদোন্নতি দিয়েছে। এবারও তা-ই হচ্ছে।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিতে এবার বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম ব্যাচকে নতুন করে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়া কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাকেও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ (নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণে) কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাও আছেন এই তালিকায়। সব মিলিয়ে ২০০-এর মতো কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেতে পারেন।
সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে ১৭৫ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়েছিল।
প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের পদ ৫০২টি। তবে বর্তমানে এই পদে আছেন ৭২৫ জন। ফলে এখন অনেক যুগ্ম সচিবকে উপসচিবের পদে কাজ করতে হচ্ছে। নতুন পদোন্নতির পর এই সমস্যা আরও বাড়বে।
অপরদিকে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে। এই পদে পদোন্নতিতে এবার নতুন করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৯তম ব্যাচকে (চাকরিতে যোগদান ২০১১) বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এই ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হওয়া ইকোনমিক ক্যাডার এবং আগে পদোন্নতি না পাওয়া বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাও এই পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। উপসচিব পদে নিয়মিত পদ আছে এক হাজারের মতো। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, সারা দেশে সমপর্যায়ের পদগুলো মিলিয়ে উপসচিব বা সমপর্যায়ের পদ আছে ১ হাজার ৭৫০-এর মতো। বর্তমানে এই পদে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৬৯৮ জন। এখন এই পদে পদোন্নতির পর অনেক উপসচিবকে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবের পদে কাজ করতে হবে।
জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে পদোন্নতি দিলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি কাজ করবে। সরকার বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্বাচনের আগে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে।
জুলাই মাসে ৫ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার এবং বদলি ও নতুন ডিসি মিলিয়ে মোট ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তুলে আনা হয়েছে দুই বছর থেকে তিন বছর দায়িত্ব পালন হয়ে যাওয়া ২২তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের। এখন ২৪, ২৫ ও ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় নির্বাচনে ডিসিরা এবং মহানগরে বিভাগীয় কমিশনাররা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ জন্য এসব নিয়োগকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বরাবরই দেখা যায়, ডিসি নিয়োগের সময় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিবেরা (পিএস) গুরুত্ব পান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আটজন পিএসকে ডিসি করা হয়েছে।
অবশ্য এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, এখানে কোনো পক্ষপাত নেই। যোগ্যতা অনুযায়ী সেরা কর্মকর্তাদের ডিসি বানানো হচ্ছে। আর বেছে বেছে সেরা কর্মকর্তাদের মন্ত্রীদের পিএস পদে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। কোনো মন্ত্রী জানেন না, কোন পিএস আসবেন।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেছেন, অতীতের ব্যাচগুলোর মধ্যে ২৫তম ব্যাচ থেকে সবচেয়ে কম জেলা প্রশাসক হয়েছে, তাই তাঁরা কিছুটা ক্ষুব্ধ। এ ব্যাচে ডিসি হয়েছেন মাত্র ২১ জন (চাকরিতে যোগদান ২০০৬)। অথচ ২৪তম থেকে ৪০ জন (যোগদান ২০০৫), ২২তম থেকে ৪২ জন (যোগদান ২০০৩), ২১তম থেকে ৩৩ জন (যোগদান ২০০৩), ২০তম থেকে ৪৮ জন (যোগদান ২০০১)। সর্বশেষ ২৭তম ব্যাচ থেকে ইতিমধ্যে ডিসি হয়েছেন ১৮ জন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাঠ প্রশাসনে এসব নিয়োগ অথবা পদায়নের যোগ্যতা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় ওই সব কর্মকর্তা কবে তথা কোন আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, চাকরিজীবনে কোথায় কোথায় পদায়ন হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ হলেও ভালো পদায়ন হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পর্যাপ্ত পদ না থাকলেও তিন দফায় জনপ্রশাসনে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২৯ আগস্ট ১৫৪ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর ১৪৯ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি এবং অক্টোবরে ২৪৯ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই বছরের (২০১৮) ২০ ফেব্রুয়ারি ৪০৭ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছিলেন। বর্তমানে এই কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে ২৪ ব্যাচের ২৬ জন এবং ২৫ ব্যাচের ২০ জন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন, যাঁদের সবাই পদোন্নতি পেয়েছেন ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে।
২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পর্যাপ্ত পদ না থাকলেও তিন দফায় জনপ্রশাসনে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরে পর্যাপ্ত পদ ছাড়াই নির্বাচনের আগে কর্মকর্তাদের খুশি করতে ঢালাও পদোন্নতি দেওয়ার ফলে জনপ্রশাসনের আদর্শ কাঠামো তো ভাঙছেই, উল্টো একধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ, পদোন্নতি পেলেও অধিকাংশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পাওয়া পদে চাকরি করতে পারছেন না। কাজ করতে হচ্ছে এক বা ক্ষেত্রবিশেষে দুই স্তর নিচের পদে। এতে ব্যক্তি লাভবান হলেও পুরো জনপ্রশাসনের ক্ষতি হচ্ছে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের কাছে তো এখন সরকারের কোনো জবাবদিহি নেই, ভোটারদের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তাই যারা তাদের টিকিয়ে রাখবে, যারা তাদের ক্ষমতায় রাখবে, সরকার এখন তাদের সুখ-দুঃখ দেখছে, তাদের সন্তুষ্ট রাখছে, তাদের স্বার্থের দিকে নজর দিচ্ছে। সরকার এখন পুরোপুরি প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। তাই পদ না থাকলেও পদোন্নতি দিচ্ছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভেঙে যাচ্ছে। নির্বাচন এলেই ক্ষমতাসীনেরা এভাবে পদোন্নতি দেয়। ২০১৩ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে এভাবে পদোন্নতি দিয়েছে। এবারও তাই হচ্ছে।