দা, লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে হামলার পর ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো—এমন একটি মামলায় আসামির তালিকায় নাম রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শওকত হোসেনের। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে গত রোববার ঢাকার গেন্ডারিয়া থানায়। আর মামলায় উল্লেখ করা ঘটনাটি গত শনিবারের।
মামলায় যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্য হয়ে থাকলে সাত মাস আগে মারা যাওয়া শওকত হয়তো ‘গায়েবিভাবে জীবিত’ আছেন বলে জানান তাঁর চাচা আবুল কাসেম। গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ হৃদ্রোগে তাঁর ভাতিজা শওকত মারা যান। তাঁকে পুরান ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত কারও নামে এ রকম মামলা দেওয়া দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এই মামলায় মৃত শওকত ছাড়াও আসামিদের তালিকায় কারাবন্দী ব্যক্তি এবং দেশের বাইরে অবস্থান করা দুজনের নাম রয়েছে।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গেন্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের মুরগীটোলা মোড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ওপর দা, লাঠিসোঁটা ও রড দিয়ে অতর্কিত হামলা করেন শওকতসহ বিএনপির নেতা–কর্মীরা। এ সময় তাঁরা ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটান। এতে আওয়ামী লীগের সাতজন নেতা আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে ইট ছুড়ে পুলিশকেও আহত করা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার বাদী গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা শাহ আলম। স্থানীয়ভাবে তিনি পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) হিসেবে পরিচিত।
মামলায় যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্য হয়ে থাকলে সাত মাস আগে মারা যাওয়া শওকত হয়তো ‘গায়েবিভাবে জীবিত’ আছেন বলে জানান তাঁর চাচা আবুল কাসেম। গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ হৃদ্রোগে তাঁর ভাতিজা শওকত মারা যান।
মামলায় আসামিদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নাম রয়েছে। তাঁর স্ত্রী গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত মাসের ২৬ তারিখে আমার স্বামীকে বাসা থেকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি এখন কেরানীগঞ্জ কারাগারে।’
আসামিদের একজন পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী শেখ শওকত হোসেন। তাঁর ছোট ভাই শেখ মোহাম্মদ আলী আলতাফ গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শওকত হোসেন গত জুন মাস থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এখন তাঁর ভাই যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
শেখ মোহাম্মদ আলী আলতাফ হোসেন বলেন, ২০১৮ সাল থেকে পুরান ঢাকায় যত গায়েবি মামলা হয়েছে, প্রায় সব মামলায় তাঁদের তিন ভাইকে আসামি করা হয়েছে। সব৴শেষ গেন্ডারিয়া থানায় এই মামলাতেও তাঁদের তিন ভাইকে (আরেক ভাইয়ের নাম শেখ ওমর ফারুক) আসামি করা হয়েছে।
গেন্ডারিয়ার বিএনপির নেতারা বলছেন, ব্যবসায়ী ওই পরিবারের কেউ বিএনপির কোনো পদে নেই। তবে তাঁরা বিএনপিকে পছন্দ করেন। সে কারণে গায়েবি মামলা হলেই ওই তিন ভাইকেও আসামি করা হয়।
গেন্ডারিয়া থানায় গত রোববার করা মামলায় ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মো. হোসেন খানকেও আসামি করা হয়েছে। তাঁর ছোট ভাই হাসান খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাঁর ভাই মালয়েশিয়ায় আছেন। সেখানে চাকরি নিয়েছেন তিনি।
সেদিন গন্ডগোলে শত শত লোক ছিল। মানুষের ভুলভ্রান্তি হতে পারে। আমরাও তো মানুষ।শাহ আলম, গেন্ডারিয়া থানায় করা মামলার বাদী
এই মামলার ১ নম্বর আসামি মকবুল ইসলাম খান গেন্ডারিয়া থানা বিএনপির সভাপতি। তিনি গেন্ডারিয়া এলাকার দুইবারের কাউন্সিলর। মকবুল বলেন, মামলার বাদী (শাহ আলম) পুলিশের সোর্স। পুলিশ তাঁকে চাপ দিয়ে মামলাটি করিয়েছে। মূল কথা হচ্ছে, বিএনপি এখন আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, এই আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতেই এমন গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। এসব মামলার উদ্দেশ্যে হয়রানি করা, আর্থিকভাবে ক্ষতিতে ফেলা, আন্দোলনকে দমানো।
এ মামলায় নাম উল্লেখ করে ১৫৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা প্রায় সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই মামলার বাদী শাহ আলমের সঙ্গে গতকাল রাতে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। নিজেকে যুবলীগের কর্মী হিসেবে তিনি পরিচয় দেন। তাঁর করা মামলায় আসামিদের মধ্যে মৃত ব্যক্তি, দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তি এবং কারাবন্দী ব্যক্তিও রয়েছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেদিন গন্ডগোলে শত শত লোক ছিল। মানুষের ভুলভ্রান্তি হতে পারে। আমরাও তো মানুষ।’
এই মামলার বিষয়ে প্রথম আলো গতকাল কয়েক দফায় গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সাঈদ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে তিনি সন্ধ্যা সাতটার পর কথা বলবেন বলে জানান। এরপর কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি আর সাড়া দেননি।
গেন্ডারিয়া থানা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী অঞ্চলের আওতাধীন। এই অঞ্চলের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহার সঙ্গে গতকাল রাতে কথা বলেছে প্রথম আলো। পুরো বিষয়টি শুনে তিনি পরে জানাবেন বলে আর ফোন ধরেননি।
মামলার এজাহারে হামলার ঘটনাস্থল হিসেবে গেন্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের মুরগীটোলা মোড় পাকা রাস্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে আশপাশের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। বেশির ভাগ দোকানি বলেন, ওই দিন আশুরার কারণে দোকান বন্ধ ছিল। তাই কী ঘটেছিল তা বলতে পারেন না তাঁরা। তবে বিএনপির নেতা–কর্মীরা আওয়ামী লীগের ওপর শনিবার এই এলাকায় হামলা চালিয়েছিল—এ রকম কোনো কথা শোনেননি তাঁরা।
মুরগীটোলা মোড়ের একজন চা–দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার বিএনপির সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে (শনিবার) ধোলাইখালে। এখানে (মুরগীটোলা মোড়) কিছু হয়নি। সেদিন এই মোড়ে আওয়ামী লীগের লোকজন ও অনেক পুলিশ ছিল।
বিএনপি নেতা-কর্মীদের হামলায় আওয়ামী লীগের যে সাতজন আহত হয়েছেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদ উল্লাহ। তিনি গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার তিনি ডিস্টিলারি রোডের মুরগীটোলা মোড়ে ছিলেন না। বিএনপি যাতে সহিংসতা করতে না পারে সেজন্য সেদিন স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে গেন্ডারিয়ার লোহারপুল এলাকায় ছিলেন। শনিবার কেউ তাঁর ওপর হামলা করেনি।
মামলায় উল্লেখ করা ‘আহত ব্যক্তিদের’ আরেকজন ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। তিনিও শনিবার ডিস্টিলারি রোডের মুরগীটোলা মোড়ে ছিলেন না।
গেন্ডারিয়া থানায় করা মামলার তথ্য অনুযায়ী, মুরগীটোলা মোড়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলায় আপনিও (জহিরুল) আহত হয়েছেন—এমন প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়ে প্রথমে মামলার বাদী কে, তা জানতে চান জহিরুল ইসলাম। পরে বাদীর নাম বলা হলে তাঁকে চেনেন না বলে জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা।