কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সিগাল পয়েন্টে স্থাপিত দোকান থেকে প্লাস্টিকের বিনিময়ে লোকজন নিচ্ছেন ডিম, সয়াবিন তেল, আটাসহ নিত্য পণ্য। গতকাল দুপুরে
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সিগাল পয়েন্টে স্থাপিত দোকান থেকে প্লাস্টিকের বিনিময়ে লোকজন নিচ্ছেন ডিম, সয়াবিন তেল, আটাসহ নিত্য পণ্য। গতকাল দুপুরে

প্লাস্টিক বোতল জমা দিলেই মিলছে টি–শার্ট, ডিম, চাল ও সয়াবিন

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট। বালুচরে স্থাপিত একটি দোকানে সামনে দেখা গেল ভ্রমণে আসা নারী-পুরুষের ভিড়। কমবেশি সবার হাতে প্লাস্টিকের বোতল। ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোর’ নামের দোকানে বোতল জমা দিয়ে কেউ নিচ্ছেন টি–শার্ট, কেউ নিচ্ছেন উপহার। আবার কাছেই সিগাল পয়েন্টে ‘প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার’ নামে আরেকটি দোকানে প্লাস্টিক বোতল দিয়ে নিম্ন আয়ের লোকজন নিচ্ছেন ডিম, কেউ চাল-আটা, সয়াবিন তেলসহ নানা নিত্যপণ্য সামগ্রী। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা গেল এই চিত্র।

কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে চার মাসব্যাপী ‘সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ কর্মসূচি’ হাতে নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কর্মসূচির উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।

উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিন, জেলা প্রশাসনের পর্যটন শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তানভীর হোসেন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য মো. জামাল উদ্দিন প্রমুখ।

উদ্বোধনী বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সৈকতে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে। এ সময় সৈকতে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ জমে। প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সামুদ্রিক প্রতিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। মারা যাচ্ছে তিমি, হাঙর-কাছিমসহ নানা সামুদ্রিক প্রাণী। পানীয় জলের শতকরা ৮০ ভাগ মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা দ্বারা দূষিত। প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসন চার মাসব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ রোধের এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যটকেরা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হবেন। স্থানীয় অধিবাসীরাও প্লাস্টিকের বিনিময়ে কেনাকাটার সুযোগ পাচ্ছেন।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একটি বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংগঠনটি পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ও অসচ্ছল শিশুদের মৌলিক শিক্ষা, আহার, চিকিৎসা এবং আইন সেবা দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের একুশে পদকে ভূষিত হয়।

বিদ্যানন্দের বোর্ড সদস্য মো. জামাল উদ্দিন বলেন, একবিংশ শতাব্দীতে অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্লাস্টিক। প্লাস্টিক দূষণে বিপন্ন প্রাণিকুলকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।  এই পৃথিবীকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য রাখতে হলে সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।

আয়োজকেরা জানান, উদ্বোধনের প্রথম দিনে ৪ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হয়েছে। চার মাসের কার্যক্রমে ১০০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক সংগ্রহের আশা করা হচ্ছে। সংগৃহীত প্লাস্টিকের একটি অংশ দিয়ে সৈকতের বালুচরে নির্মাণ করা হবে ভাস্কর্য।

চাল, ডিম, সয়াবিন ও আটা পেয়ে খুশি

সৈকতের ঝাউবন থেকে ৪ কেজি প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে সিগাল পয়েন্টে নিয়ে আসেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী সানোয়ারা বেগম। বিনিময়ে তিনি নেন এক কেজি ওজনের সয়াবিন তেলের বোতল। সানোয়ারা (৩০) বলেন, একটি রেস্তোরাঁতে সারা দিন কাজ করে ৪০০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এই টাকার পাঁচ সদস্যের সংসার চলে না। প্লাস্টিকের বিনিময়ে পাওয়া ভোজ্যতেল তাঁর উপকারে আসবে।

তিন কেজি প্লাস্টিক জমা দিয়ে এক কেজি মসুর ডাল নেন আরেক নারী সাবিনা ইয়াছমিন। তিন কেজি প্লাস্টিক জমা দিয়ে দুই কেজি আটা নেন হোটেল কর্মী সাইদুল। অনেকে প্লাস্টিক জমা দিয়ে নিচ্ছেন ডিম, চাল, ডাল, আলু, আটা, ময়দাসহ ১৯ ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।

প্লাস্টিক নিয়ে আসা আবুল কালাম (৪৫) বলেন, সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন সড়ক থেকে সংগ্রহ করা এক কেজি প্লাস্টিক বাজারে বিক্রি করলে পাওয়া যায় ২০ থেকে ৩০ টাকা। কিন্তু এখানে পাওয়া যাচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা।

আয়োজকেরা জানান, ১ কেজি প্লাস্টিক দিয়ে ১ কেজি চাল, অথবা ৬ টি ডিম পাওয়া যাচ্ছে। তাতে দরিদ্র মানুষ লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে ধারণাও পাচ্ছেন। বেলা তিনটা পর্যন্ত সিগাল পয়েন্টে প্লাস্টিক জমা দিয়ে প্রায় ৫০০ জন দুস্থ নারী-পুরুষ পছন্দের পণ্য সংগ্রহ করেন।

অন্যদিকে সুগন্ধা পয়েন্টের ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোরে’ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বোতল জমা দিয়ে পর্যটকেরা পাচ্ছেন টি–শার্টসহ নানা উপহারসামগ্রী।

ঢাকার বংশাল থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক কামরুল ইসলাম বলেন, সৈকতে নামার সময় প্রতিটি মানুষের হাতে প্লাস্টিকের পানির বোতল থাকে। পানি খাওয়া শেষ হলে বোতলটি ডাস্টবিনে না ফেলে বালুচরে নিক্ষেপ করেন। অনেকে চিপসের প্যাকেট, ক্যান ফেলে রাখেন। সমুদ্রের জন্য এসব ক্ষতিকর। সৈকতের আশপাশ থেকে তিনি বেশ কিছু প্লাস্টিক বোতল কুড়িয়ে দোকানে জমা দিয়ে টি–শার্ট উপহার পান।

আয়োজকেরা জানান, চার মাস ধরে কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন সৈকতে দূষণ রোধের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও কক্সবাজার সৈকতে আরও তিনটি অস্থায়ী বুথ স্থাপন কর করা হবে।