ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রয়াণবার্ষিকী আজ

সাধক শিল্পীর সরল জীবন

সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ
ছবি: সংগৃহীত

‘রুটি পাওয়া যাবে তো? আমি বাবা দিনে বাঙালী। রাত্রে পশ্চিমা।’ কথাটি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর। যাঁকে বলছেন, তাঁর নাম শুভময় ঘোষ। দুজনের দেখা হয়েছিল বোলপুরে—দুজনেরই গন্তব্য শান্তিনিকেতন। তারিখটা ১৯৫২ সালের ২৩ অক্টোবর।

শুভময়ের স্মৃতিতে, ‘বোলপুরে বাসের কাছে খুব ভিড়। দেখলুম তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পিঠে কাপড়ের খোলে জড়ানো বাজনা। সঙ্গে একটি প্রিয়দর্শন ছোট ছেলে, তার কাঁধেও একটি বাজনা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। সঙ্গে তাঁর নাতি, আলী আকবর খাঁর ছেলে আশিস খাঁ।’

শাস্ত্রীয় সংগীতের মহাসাধক, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সেদিন নিজ থেকেই বাসে সবার সঙ্গে আলাপ করে নিলেন। কথায় পূর্ববঙ্গের ছাপ যথেষ্ট। শান্তিনিকেতনে আগেও এসেছেন।

শুভময় ঘোষ ওই দুই মাসে নিয়ম করে শুনলেন নমস্য এই সংগীতব্যক্তিত্বের জীবনকথা, তাঁর মুখেই। এভাবে বেরোল আলাউদ্দিন খাঁর আত্মজীবনী আমার কথা।

সেবার (১৯৫২) শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের নতুন হোস্টেলে দুই মাস ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এই সংগীতগুরুকে ‘দিনেন্দ্র অধ্যাপক’ পদে আহ্বান জানিয়ে শান্তিনিকেতনবাসীদের তাঁর সংগীত ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মহৎ সুযোগ দিয়েছিলেন। লেখক, সাংবাদিক শুভময় ঘোষের লেখায়, ‘রোজ সন্ধ্যায় যখন নাতিকে তালিম দেন, সবাই আসে, শোনে। অত্যন্ত আমুদে, আলাপী, অমায়িক, বিনয়ী লোক। চমৎকার কথা বলেন। বাজনার সঙ্গে সঙ্গে গল্পগুজব, গান অনেক কিছু হয়। তাঁর গল্প তাঁর বাজনার মতোই মনোহর। হাসি এবং রসিকতায় ভরা।’

শুভময় ঘোষ ওই দুই মাসে নিয়ম করে শুনলেন নমস্য এই সংগীতব্যক্তিত্বের জীবনকথা, তাঁর মুখেই। এভাবে বেরোল আলাউদ্দিন খাঁর আত্মজীবনী আমার কথা। সহলেখক শুভময় ঘোষ, যিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক সাগরময় ঘোষেরই ভাই। বইটি প্রথম বেরিয়েছিল ১৯৫৭ সালে। বহুদিন দুষ্প্রাপ্য ছিল। এরপর কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বইটি বেরোয় ১৯৮০ সালে। যুক্ত হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা।

আলাউদ্দিন খাঁর (৮ অক্টোবর ১৮৬২-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২) জীবনের পাণ্ডুলিপি মোটামুটি অনেকেরই পড়া। সংগীত পরিবারে জন্ম, মায়ের সঙ্গে রাগ করে সেই ১০ বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের শিবপুর গ্রাম থেকে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় আসা, লঙ্গরখানায় খাওয়া, লোকের বাড়ির বারান্দায় ঘুমানো, শাস্ত্রীয় সংগীত শেখার যত যন্ত্র আছে—বাঁশি, তবলা, কর্নেট, সানাই, সরোদ, বেহালা, তানপুরা, ভায়োলিন, সুরবাহার

বইয়ের ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ‘বাবা’র চরিত্রের মজার কিছু দিক তুলে ধরেছেন। বলে নেওয়া ভালো, শিষ্যরা আলাউদ্দিন খাঁকে বাবা নামেই ডাকেন। আর রবিশঙ্কর ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁর বড় কন্যা রওশন আরা বেগমের (অন্নপূর্ণা) স্বামী। যদিও অন্নপূর্ণার সঙ্গে পরে বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। সেদিক থেকে তো বাবাই।

—সবই বিভিন্ন ওস্তাদের ডেরায় ধরনা দিয়ে রপ্ত করা এবং সর্ববাদ্যে বিশারদ হয়ে ওঠা। একপর্যায়ে মাইহারের (ভারতের মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত) মহারাজা ব্রজনারায়ণের আমন্ত্রণে সেই রাজ্যের সংগীতগুরু হয়ে সেখানে বসবাস, ভারতজুড়ে অসংখ্য শিষ্য তৈরি। নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ৬৭ বছর বয়সে জাহাজে করে ইউরোপ ভ্রমণ মাইহার ঘরানার এই শিল্পীর জীবনের আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

বইয়ের ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ‘বাবা’র চরিত্রের মজার কিছু দিক তুলে ধরেছেন। বলে নেওয়া ভালো, শিষ্যরা আলাউদ্দিন খাঁকে বাবা নামেই ডাকেন। আর রবিশঙ্কর ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁর বড় কন্যা রওশন আরা বেগমের (অন্নপূর্ণা) স্বামী। যদিও অন্নপূর্ণার সঙ্গে পরে বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। সেদিক থেকে তো বাবাই।

আলাউদ্দিন খাঁ ছাত্রদের বাবুয়ানি একদম পছন্দ করতেন না। তা সে শৌখিন জামা পরা হোক বা ফুলেল তেল দিয়ে টেড়িকাটা অবধি। ভয়ে ছাত্ররা সব সময় মোটা কাপড়ের জামা পরে আর চুলে কদম ছাঁট দিয়ে বসে থাকত। আলাউদ্দিন খাঁর এক ছাত্রের খুব সুন্দর ঘন কোঁকড়া চুল ছিল। সে চুলের মায়া ত্যাগ করতে না পেরে একটা উপায় বের করেছিল। আমার কথার ভূমিকায় রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘মাথার ধারের দিকের চুলগুলো কামিয়ে টংয়ের চুলগুলো চমৎকার বহাল রেখেছিল। আর ওই চুলের ওপর বসিয়ে রাখত একটা গান্ধী টুপি। যাতে বাবা ওর চুলগুলো দেখতে না পান।’

একদিন বাজাতে গিয়ে ছেলেটা একটা ভুল করে বসল। ‘চটেমটে বাবা ওকে একটা জোর থাপ্পড় কষলেন। ছোটখাটো পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির মানুষ হলে কী হবে, বাবার চড়-চাপড়ে ইয়া-ইয়া চেহারার শাগরেদদের ধরাশায়ী হয়ে যেতে দেখতাম। চড় মারতেই ছেলেটার টুপিটা মাথার ওপর থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল। আর অমনি ওর বাহারি চুল বেরিয়ে পড়ল।’

সেদিন ছেলেটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
আলাউদ্দিন খাঁর মেজ মেয়ে জাহানারা অসুস্থ। তবু তাঁকে যেতে হলো মাইহারের মহারাজার ছেলের বিয়েতে, বরযাত্রী হয়ে। ফিরে এসেই শুনলেন দুঃসংবাদ। ডাক্তার সব রকমের চেষ্টা করেছিলেন। শেষ অবধি ইনজেকশন দেন। কিন্তু জাহানারাকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু ‘বাবা যা কানে শুনলেন, তা হলো ডাক্তার ইনজেকশন দেবার পরই তাঁর মেয়ে মারা গেছে।’ মুহূর্তের মধ্যে হায় হায় করে ছুটলেন ডাক্তারকে পেটাতে, ‘শয়তান ডাগডর মেরা লেড়কিকো মার ডালা! মেরে পিয়ারি লেড়কিকো মার ডালা!’

বইয়ের তথ্য বলছে, সেদিন মাইহারের লোকেরা মানুষটির অদ্ভুত আচরণে তাঁর মনের পুঞ্জীভূত ব্যথার ছাপ দেখে একাধারে হেসেছেন এবং কেঁদেছেন।

রবিশঙ্কর জানাচ্ছেন, বাবা বাজারে গিয়ে যা কিছু কিনতেন, চেঁচামেচি দরদস্তুর করতেন। সামান্য দু–এক পয়সা দামের জন্য দরাদরি করে পাগল করে দিতেন তরকারিওয়ালা কি মেছুনিদের। আবার সেই বাবাই বাড়ি ফিরে লাইন করে দাঁড়ানো ভিখিরিদের মুঠো মুঠো চাল–ডাল দিতেন, পয়সা দিতেন।

হায়দরাবাদ, কাশ্মীরসহ নানা দরবার থেকে মোটা মাইনের চাকরির আমন্ত্রণ এসেছিল আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। কিন্তু মাইহারের রাজার ভক্তি–ভালোবাসা আর পৌনে দুই শ টাকার সামান্য বেতন ছেড়ে কোথাও যাননি তিনি। রবিশঙ্করের কথায়, অর্থের লিপ্সা বলে কিছু বাবার ছিল না। শিষ্যবর্গের কাছ থেকে একটা দানাপানিও না নেওয়ার দর্শন ছিল তাঁর। কোনো কোনো আয়োজক সম্মান দেখিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি কথায় খুব অল্প পয়সাতেই তাঁকে দিয়ে বাজিয়ে নিতেন।

একবার এক জলসায় রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খাঁকে উদ্যোক্তারা যা দিচ্ছিলেন, তাঁর অনেক কমেই তাঁদের বাবাকে রাজি করিয়ে ফেললেন। রবিশঙ্করের ভাষ্যে, ‘যখন ব্যাপারটা জানতে পারলাম, তখন লজ্জায় মুখ রাখার জায়গা থাকত না। আমাদের গুরু আমাদের চেয়ে কম পাচ্ছেন ভাবতেই কী খারাপ লাগত!’

বইয়ে আলাউদ্দিন খাঁ বলেছেন তাঁর জীবনের কথা। ইউরোপ সফরের সময়কার একটা ঘটনা দিয়ে শেষ হোক তাঁর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্য। প্যারিসে থাকাকালে একদিন হোটেলে কয়েকটি আমেরিকান ও ইউরোপীয় তরুণী এল। আলাউদ্দিন খাঁর সরোদ শুনবে। তিনি ভাবলেন, ওদের মহলে ওরিয়েন্টাল মিউজিকটাই ফ্যাশন। তাই হয়তো শুনে যেতে এসেছে। বিকেল তিনটা বাজে। বিরক্তির সঙ্গে ধরলেন ভীমপলশ্রী।

আরম্ভের সঙ্গেই দেখলেন, না, এরা সে রকম মেয়ে নয়। সুরের ভেতর ঢুকতে চাইছে। তিন ঘণ্টা বাজালেন। মেয়েরা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে আর চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। তাঁর স্মৃতিচারণা, ‘কান্না আর থামে না। গলা বন্ধ। পরমুহূর্তেই ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেতে লাগল।’