২৫ মার্চ, ১৯৭১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ–এর লেখা বই একাত্তরের মুজিব সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে। এ বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার, বন্দিজীবন, মুক্তি ও দেশে ফিরে আসার আখ্যান উঠে এসেছে। আজ ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ দিন রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার  হয়েছিলেন। বইটি থেকে ‘গ্রেপ্তার’ শিরোনামে অধ্যায়ের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করবে, সন্ধ্যার পর থেকেই ছিল এমন গুঞ্জন। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কাউকে না জানিয়ে গোপনে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসায় ভিড় ছিল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর। সবাইকে নিরাপদে চলে যেতে বলেন তিনি। কিন্তু তিনি থেকে যান বাড়িতেই। রাত ১১টার সময় ঢাকার রাস্তায় সামরিক বাহিনীর কনভয় নামে। সময় যতই পেরোয়, ততই বাড়তে থাকে গোলাগুলির শব্দ। রাত দেড়টার সময় একটি কমান্ডো দল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে।

যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন

যে কমান্ডো দলটি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল, তার দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল (পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার) জেড এ খান। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারের কর্নেল আহমদের কাছ থেকে শেখ মুজিবকে পরদিন অথবা তার পরদিন গ্রেপ্তার করার নির্দেশ পান তিনি। ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় গ্রেপ্তারের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। ২৫ মার্চ সকালে জেনারেল আবদুল হামিদ কর্নেল জেড এ খানকে স্মরণ করিয়ে দেন, শেখ মুজিবকে অবশ্যই জীবিত ধরতে হবে। কর্নেল খান তিনটি গ্রুপে তাঁর সেনাদের ভাগ করে তাদের মেজর বিলাল, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও ক্যাপ্টেন সাঈদের অধীনে ন্যস্ত করেন। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন সাঈদ শেখ মুজিবের বাড়ির আশপাশ রেকি করেন। দলটি এয়ারফিল্ড থেকে রওনা হয় রাত ১১টায়। পথে কয়েকটি ব্যারিকেড সরিয়ে তারা ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছায়। অপারেশনটি কর্নেল খান বর্ণনা করেছেন এভাবে:

নিচতলা সার্চ করা হয় কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় না।

অনুসন্ধানী দল ওপরতলায় যায়। যেসব কামরা খোলা, ওখানে কাউকে পাওয়া গেল না। একটি কামরা ভেতর থেকে আটকানো। আমি ওপরতলায় গেলে একজন আমাকে বলে, বন্ধ কামরাটার ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমি মেজর বিলালকে বন্ধ কামরাটার দরজা ভেঙে ফেলতে বলে ক্যাপ্টেন সাঈদ এসেছে কি না, দেখার জন্য নিচতলায় নেমে আসি।...

আমি ক্যাপ্টেন সাঈদকে গাড়িগুলো কীভাবে লাইন করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছিলাম, তখন প্রথমে একটি গুলির শব্দ, তারপর গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং শেষে সাবমেশিনগান থেকে ব্রাশফায়ারের আওয়াজ শুনতে পাই। ভাবলাম, কেউ বুঝি শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। আমি ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে ওপরতলায় গিয়ে যে ঘরটি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সেটির দরজার সামনে কম্পিত অবস্থায় শেখ মুজিবকে দেখতে পাই। আমি তাঁকে আমার সঙ্গে যেতে বলি।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবেন কি না। আমি অনুমতি দিই। তিনি কামরাটার ভেতরে যান। সেখানে পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসেন। আমরা গাড়িগুলো যেখানে, সেদিকে হাঁটতে থাকি। ক্যাপ্টেন সাঈদ তখনো তাঁর গাড়িগুলো ঘোরাতে সক্ষম হননি। আমি ইস্টার্ন কমান্ডে একটি রেডিও বার্তা পাঠাই যে শেখ মুজিবকে ধরা গেছে।

মুজিব এ সময় আমাকে বললেন, তিনি ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন। আমি আবার তাঁর সঙ্গে ফিরে আসি। পাইপ নিয়ে নেন তিনি। এর মধ্যে শেখ মুজিব নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আমরা তাঁকে হত্যা করব না। তিনি বললেন, আমরা তাঁকে ডাকলেই হতো, তিনি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতেন। আমরা তাঁকে বলি, আমরা তাঁকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা ফিরে আসতে আসতে ক্যাপ্টেন সাঈদ তাঁর গাড়িগুলো লাইন করে ফেলেন। শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে ওঠানো হয়। আমরা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা করি।

একাত্তরের মুজিব, মহিউদ্দিন আহমদ প্রথমা প্রকাশন

আমি পরে জানতে পারি, মেজর বিলালকে ওপরতলায় বন্ধ রুমের দরজাটা ভাঙার জন্য বলে আমি গাড়ির অবস্থা দেখার জন্য যখন নিচে নেমে আসি, ওর সেনারা যেখানে জড়ো হয়েছিল, কেউ একজন সেদিক লক্ষ্য করে একটি পিস্তল দিয়ে গুলি করে। ভাগ্যক্রমে কেউ আঘাত পায়নি। কেউ থামানোর আগেই ওর এক সেনা বারান্দার যেদিক থেকে পিস্তলের গুলি এসেছিল, সেদিকে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তারপর সাবমেশিনগানের শব্দে শেখ মুজিব বন্ধ কামরার ভেতর থেকে ডাক দিয়ে বলেন যে তাঁকে হত্যা করা হবে না—এই নিশ্চয়তা দেওয়া হলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। তাঁকে নিশ্চিত করা হয়। তখন তিনি বেরিয়ে আসেন।

শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছেন, এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করেনি। আওয়ামী লীগের নেতারা এ ব্যাপারে প্রথম দিকে মুখ খোলেননি। একটা আশঙ্কা ছিল, পাকিস্তানিরা তাঁকে মেরে ফেলতে পারে।

শেখ মুজিব যখন গ্রেপ্তার হন, জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন ঢাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর কামরার জানালা দিয়ে দেখছেন, দৈনিক দ্য পিপল-এর অফিস সৈন্যরা পুড়িয়ে দিচ্ছে। পরদিন তিনি করাচি চলে যান। জেনারেল টিক্কা খানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পাকিস্তানি গবেষক লে. জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন। তাঁর ভাষ্যে জানা যায়, ভুট্টো পরদিন হোটেল ছেড়ে ঢাকা বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে সেনানিবাসে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে দেখে শেখ মুজিব ঠাট্টা করে উর্দুতে বলেন, ‘তুমহারা বাপ তো গায়া’ (তোমার বাপ তো চলে গেছে)। ভুট্টোকে না জানিয়ে ইয়াহিয়ার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি এই ইঙ্গিত করেছিলেন। ভুট্টো নীরবে এই অপমান সহ্য করেন।

কখনো কখনো দুঃখের মধ্যেও কৌতুকজনক ব্যাপার ঘটে। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার নিয়ে এমন একটি কাণ্ড ঘটেছিল। এ রকম একটি ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় খাদিম হোসেন রাজার কাছ থেকে। উল্লেখ্য, তিনি আর রাও ফরমান আলী মিলে তৈরি করেছিলেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করতেন। শেখ মুজিবের সাংকেতিক নাম ছিল ‘ময়না’।

জেনারেল রাজার বাসায় একটি পোষা ময়না পাখি ছিল। সিলেট থেকে তাঁর এক বন্ধু এটা পাঠিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে রুবিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মার্চেই তিনি মেয়েকে পিআইএর একটা ফিরতি ফ্লাইটে লাহোরে পাঠিয়ে দেন। তার সঙ্গে ফোনে নিয়মিত কথা হতো। ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপের সময় ‘ময়না’ প্রসঙ্গও থাকত। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর কী ঘটেছিল, এ নিয়ে তিনি বলেন:

২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে লে. কর্নেল জেড এ খান খুব বেশি রক্তপাত না ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন। শেখ মুজিবের গায়ে কোনো আঘাত লাগেনি। তাঁকে জিওসির বাসার কাছেই মেয়েদের একটা স্কুলে রাখা হয়। তাঁর পাহারাদারের সংখ্যা কমাতে আমি তাঁকে কমান্ড হাউসের গেস্টরুমে নিয়ে আসি। রাতে নির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার সময় গোলাগুলির অনেক শব্দ হয়। সম্ভবত ময়না পাখিটার জান খুব দুর্বল ছিল। প্রচণ্ড শব্দ সহ্য করতে না পেরে সে অক্কা পায়। আমার স্ত্রী ফোনে মেয়েকে ঢাকার পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে বলে যে ময়না মারা গেছে। ওই মুহূর্তে সাংকেতিক ‘ময়না’ নামের কথা তাদের মাথায় আসেনি। রাত তখন শেষের দিকে। লাহোরে আমার পরিবারে রটে যায় শেখ মুজিব মারা গেছেন। ২৬ মার্চ সকালে আনুষ্ঠানিক সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে আসল খবরটি প্রকাশ পায়—শেখ মুজিব কর্তৃপক্ষের হেফাজতে নিরাপদে আছেন।

আগেই ঠিক করা ছিল, ২৬ মার্চ সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতারে ভাষণ দেবেন। ঢাকায় সামরিক কর্মকর্তারা অপেক্ষা করছিলেন, তিনি কী বলেন তা শুনতে। সামরিক বাহিনীর ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনসের (আইএসপিআর) প্রধান ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী তখন ঢাকায়। তিনি শুনলেন, প্রেসিডেন্ট ‘উদ্ধত স্বরে তর্জন-গর্জন করে’ ভাষণ দিচ্ছেন। ভাষণে তিনি বলেন: 

সে (মুজিব) দেশের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত করেছে। এই অপরাধের শাস্তি পেতেই হবে। আমরা কতিপয় ক্ষমতালোভী ও দেশপ্রেমহীন মানুষকে ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। আমি সামরিক বাহিনীকে তাদের কর্তব্য পালন এবং দেশের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করার নির্দেশ দিয়েছি। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।

২৫ মার্চ রাতের বাকি সময়টুকু শেখ মুজিবকে ঢাকা সেনানিবাসে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে রাখা হয়। পরদিন তাঁকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে স্থানান্তর করা হয়। তিন দিন পর তাঁকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল করাচির ডন পত্রিকায় করাচি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সেনা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাঁর ছবি ছাপা হয়। ছবিতে দেখা যায় তিনি একটি সোফার ওপর বসে আছেন। ছবি দেখে সবাই নিশ্চিত হন, শেখ মুজিব জীবিত ও অক্ষত আছেন। করাচি থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সরাসরি লায়ালপুর জেলে। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর জন্য একজন বাঙালি বাবুর্চি জোগাড় করা হয়। তাঁকে তাঁর প্রিয় ব্র্যান্ডের তামাক সরবরাহ করা হয়। সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার জন্য একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা হয়।

ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বলেছেন, কীভাবে ২৫ মার্চ রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কথোপকথনের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো—

ফ্রস্ট: সে রাতের কথা বলুন, যখন একদিকে আপনার সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং একই সঙ্গে আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে রাতে আপনি বাড়িতে ছিলেন। সেখানে পাকিস্তানিরা হামলা চালায় ও আপনাকে গ্রেপ্তার করে। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গেলেন না এবং গ্রেপ্তার বরণ করলেন? কেন এ সিদ্ধান্ত?

মুজিব: সে এক কাহিনি। সে রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একটা কমান্ডো দল আমার বাড়ি ঘেরাও করে। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমাকে খুন করে প্রচার করবে যে বাংলাদেশের চরমপন্থীরা আমাকে মেরেছে। এভাবেই তারা হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করবে। আমি ঠিক করলাম, আমি মরি তা-ও ভালো। তবু আমার দেশবাসী বাঁচুক।

ফ্রস্ট: আপনি কলকাতায় চলে যেতে পারতেন।

মুজিব: ইচ্ছা করলে আমি যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশের মানুষকে ছেড়ে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি লড়াই করব, মরব। পালিয়ে যাব কেন? দেশবাসীর প্রতি আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো।

ফ্রস্ট: আপনার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই ঠিক ছিল। এ ঘটনাটি ৯ মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি তো তাদের কাছে ঈশ্বরতুল্য। 

মুজিব: আমি তা বলব না। তবে এটা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছি। আমি তাদেরকে রক্ষা করতে চেয়েছি। কিন্তু হানাদাররা সে রাতে আমাকে গ্রেপ্তার করে। ওরা আমার বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে আমার ৯০ বছর বয়সী বাবা ও ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা ছিলেন। গ্রামের সে বাড়ি তারা ধ্বংস করে দেয়। ওরা গ্রামে সৈন্য পাঠিয়ে আমার মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তাঁদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার মা-বাবার আর কোনো আশ্রয় থাকল না। ওরা সবকিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগা মানুষদের মারবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমার দলের শক্তি আছে। আমি সারা জীবন ধরে একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, এটাই হয়তো আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

ফ্রস্ট: আপনাকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হলো? তখন তো রাত দেড়টা। 

মুজিব: ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালায়।

ফ্রস্ট:ওরা যখন আসে, তখন আপনি বাড়ির কোনখানটায় ছিলেন?

মুজিব: এই যে দেখছেন আমার শোবার ঘর, এ ঘরেই বসে ছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকে। এদিক-ওদিক সব দিক থেকে গুলি ছোড়ে। জানালার ওপর গুলি চালায়।

ফ্রস্ট: এগুলো সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?

মুজিব: হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবারের সঙ্গে ছিলাম। একটি গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছোট ছেলেটি তখন বিছানায় শোয়া। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দুটি সন্তান নিয়ে বসে ছিলেন।

ফ্রস্ট: সৈন্যরা কোন দিকে দিয়ে ঢুকেছিল?

মুজিব: সব দিক দিয়ে। ওরা জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমার স্ত্রীকে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসি।

ফ্রস্ট: আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?

মুজিব: না, কোনো কিছু বলার মতো অবস্থা তখন ছিল না। আমি তাঁকে বিদায় সম্ভাষণ জানাই। দরজা খুলে বাইরে এসে ওদের বলি গুলি বন্ধ করতে। বলি, গুলি বন্ধ করো। আমি তো এখানেই দাঁড়িয়ে। তোমরা গুলি করছ কেন? তোমরা কী চাও? তখন চারদিক থেকে ওরা ছুটে এল। তাদের হাতে উদ্যত বেয়নেট। একজন অফিসার বলল, অ্যাই, ওকে মেরে ফেলো না।

ফ্রস্ট: একজন অফিসার ওদের থামিয়েছে?

মুজিব: হ্যাঁ, ওই অফিসারটি থামিয়েছে। ওরা আমাকে টেনে নামায়। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে। আমি বলি, আমাকে আমার তামাক আর পাইপটা আনতে দাও। ওরা একটু থামে। আমি ওপরে গিয়ে তামাক আর পাইপটা নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী দুটি ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমাকে কিছু কাপড়চোপড়সহ একটা ছোট স্যুটকেস দেন। আমি তা–ই নিয়ে আসি। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকেই ওরা আমাকে নিয়ে যায়।

ফ্রস্ট: ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আপনি কি ভেবেছিলেন, এটা আবার দেখতে পাবেন?

মুজিব: না। ভেবেছি এটাই হয়তো শেষ। কিন্তু আমি মাথা উঁচু রেখে যদি মরি, তারা এতে লজ্জা পাবে না। কিন্তু আমি যদি তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করি, আমার জাতি, আমার দেশ দুনিয়ার সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। জনগণের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমার মৃত্যুই শ্রেয়।

ফ্রস্ট: আপনি একবার বলেছিলেন, ‘যে মৃত্যুর জন্য তৈরি, তাকে হত্যা করা যায় না।’ বলেননি এ কথা?

মুজিব: আমি তাদের বলেছি, যে মৃত্যুর জন্য তৈরি, তাকে কেউ মারতে পারে না। তুমি একজনকে শারীরিকভাবে মারতে পারো। কিন্তু তার আত্মাকে কি পারো? তুমি পারো না। এটা আমার বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান। একজন মুসলমান কেবল একবারই মরে, দুবার নয়। আমি এই জাতির নেতা। আমার জনগণ আমাকে ভালোবাসে এবং আমি তাদের ভালোবাসি। তাদের কাছে এখন আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। তারা আমার জন্য সর্বস্ব দিয়েছে। কারণ, আমিও তাদের জন্য সর্বস্ব দিতে তৈরি ছিলাম। আমি তাদের মুক্তি দিতে চাই। মরতে আমার আপত্তি নেই। আমি তাদের সুখী দেখতে চাই। আমার জনগণ আমাকে যে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছে, সেটা অনুভব করলে আমি আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ি।

তথ্যসূত্র

১. Khan, Z A (1998), The Way It Was, Dynavis, Karachi, p. 262-271; অনুবাদ: ফারুক মইনউদ্দীন, প্রথম আলো , ২৫ মার্চ ২০০২

২. Matinuddin, Lt. Genarel Kamal, Tragedy of Errors: East Pakistan Crisis 1968-1971, Wajidalis, Lahore, p. 248

৩. Raja, p. 52

৪. ibid

৫. Siddiqi, Brigadier A R (2005), East Pakistan: The Endgame, An Onlooker’s Journal 1969-1971, Oxford University Press, Karachi, p. 101

৬. Karim, S A (2009), Sheikh Mujib : Triumph and Tragedy, UPL, Dhaka, p. 224

৭. Bangladesh Documents, Ministry of External Affairs, New Delhi, Vol.II, p. 614-627