মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় অংশ কাজ করে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে। দিনের বেলায় প্রচণ্ড তাপের মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হয়। এতে তাপজনিত নানা রোগে শুধু কিডনি নয়, মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব দেশে তাপ আরও বাড়ছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে অতিরিক্ত তাপ।
‘প্রাণঘাতী তাপ: উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী কর্মীদের ওপর চরম তাপমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠার রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) আজ রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রামরু এবং অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক বাংলাদেশ সংসদীয় ককাস যৌথভাবে এটি আয়োজন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উপসাগরীয় অঞ্চলের (মধ্যপ্রাচ্য) ছয়টি দেশে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বছরে ১০ হাজার প্রবাসী মারা যান। তাঁদের প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কোনো অন্তর্নিহিত কারণ কার্যকরভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রাকৃতিক কারণ বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হিসেবে মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়। বিপজ্জনক ঝুঁকি সত্ত্বেও কর্মীদের ওপর তাপের প্রভাব সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। তাপসংক্রান্ত কারণে প্রাণহানি বা কোনো মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্যের কোনো নিবন্ধন নেই।
সংসদীয় ককাসের সদস্য ও সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার বলেন, অধিকাংশ কর্মী বিদেশে যান দালালের মাধ্যমে। গিয়ে তাঁরা আর কোনো সহযোগিতা পান না। মধ্যপ্রাচ্যের অসহনীয় গরমে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্রবাসীরা জীবন যাপন করছেন। তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দূতাবাস এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।
প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার। শুরুতে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে বড় বিষয়। এতে অভিবাসী শ্রমিকেরা বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাঁদের চিকিৎসাসুবিধা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হয়নি।
রামরুর প্রতিবেদন বলছে, চরম তাপ ও সূর্যালোকে দীর্ঘ সময় কাজ দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে পরিচালিত করে, যার জন্য আজীবন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এর ফলে অকালমৃত্যু ও অক্ষমতা হয়। দিন ও রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শরীরে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করে এবং শ্বাসতন্ত্র ও হৃদ্রোগ, বহুমূত্র রোগ, কিডনি রোগের প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কুয়েতের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গ্রীষ্মের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির জন্য ঝুঁকি গড়ে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
সৌদি আরবে চিকিৎসক হিসেবে ৩৩ বছর কাজ করেছেন মো. মনিরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই মানুষ মারা যান। এটা মৃত্যুর কারণ নয়। এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সেই কারণ এখানে বলা হচ্ছে না। অথচ সৌদি আরবে মৃত্যুসনদের জন্য হাসপাতালের ফরমে সব ধরনের তথ্য দেওয়া থাকে। সব কারণ বলা থাকে। এ কারণ জানার অধিকার সবার আছে। তাই দূতাবাসের উচিত এটা পরিষ্কার করে জানানো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের দিলদার হোসেন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে পানির দাম বেশি। কর্মীরা পানি কম খান। আবার কাজের চাপে হয়তো সময়ও পান না। কিন্তু প্রচুর ঘাম হয়। এতে শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হয়। কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আবার নিয়মিত প্রস্রাব না করায় সংক্রমণ হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চল দীর্ঘ সময় ধরে উত্তপ্ত থাকে। বছরে ১০০ থেকে ১৫০ দিনের জন্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে কুয়েত, বাহরাইন ও সৌদি আরবের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৮০ দিনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন অনুষ্ঠানে বলেন, নারী কর্মীরা মানসিক চাপ নিয়েই যান। তাঁদের কর্মস্থলে থাকার জায়গা ভালো নয়। পুষ্টিকর খাবার পান না। প্রবাসে মৃত্যুর যথাযথ কারণ জানা যায় না, দূতাবাস সহায়তা করে না বলে।
কর্মীদের আবাসন, পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে রামরুর প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, লাখো প্রবাসী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, তাই তাদের সুরক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর তদন্ত প্রক্রিয়া উন্নত করতে হবে। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা। তাপ থেকে সুরক্ষার জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাতে হবে।