ফারহিম আঞ্জুম সোহানা
ফারহিম আঞ্জুম সোহানা

‘দৃষ্টিজয়ী’ নারীর গল্প

‘যাঁরা কটু কথা বলতেন, তাঁরাও এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করেন’

জন্ম থেকেই দুই চোখে দেখতে পান না ফারহিম আঞ্জুম সোহানা। তবে নিজের মেধা ও যোগ্যতায় এখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গানের তালিকাভুক্ত শিল্পী তিনি।

ফারহিম আঞ্জুম নিয়মিত বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও মঞ্চে গান গাচ্ছেন। বেশ কিছু পুরস্কার এবং সম্মাননাও পেয়েছেন। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির মিউজিক্যাল রিয়েলিটি শো ‘অদম্য সুর’–এ প্রথম রানারআপ হয়েছেন। ফারহিম চান, এমন একদিন আসবে, যখন কেউ আর মনে করিয়ে দেবে না যে তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।

ফারহিম নিজেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী না বলে বলেন দৃষ্টিজয়ী। তাঁর মতে, তিনি চোখে দেখতে পান না বলে তো জীবন থেমে নেই। দৈনন্দিন জীবনে যেটুকু প্রয়োজন, সে কাজটুকু নিজেই করতে পারেন। পড়াশোনার পাশাপাশি গানের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংসার করছেন। তবে তিনি মনে করেন, এ চলার পথে বাবার বাড়ি ও স্বামীর বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছেন বলেই তাঁর জীবনটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

রাজধানীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন ফারহিম। সেখানেই কাজল রেখা নামের এক শিক্ষকের কাছে গান শেখা শুরু। ফারহিম বর্তমানে তেজগাঁও মহিলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন।

ফারহিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, আমি তো সংসারের বোঝা। আমার বিয়ে হবে না। বিয়ে হলেও সংসার করতে পারব না। আমার জন্য এত কষ্ট করে কী লাভ? তবে আমার পরিবার কখনোই আমাকে অবহেলা করেনি।’

প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে ফারহিম শোনালেন তাঁর জীবনের গল্প। এ সময় সঙ্গে তাঁর স্বামী ও বড় বোন ছিলেন। ফারহিম জানান, সাত বছর বয়স থেকেই তিনি গান শেখা শুরু করেছিলেন।

ফারহিমের বাবা আবুল বাসার মিয়া অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। মা কোরেশা বেগম বাংলাদেশ টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ টিভি টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত। বড় বোন ফারিহা আঞ্জুম বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। আর স্বামী মশিউর রহমান র‍্যাপিড ট্রানজিট ফ্রেইট লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (সিনিয়র এক্সিকিউটিভ)।

ফারহিম জানান, বড় বোন গান শিখতেন। তা থেকেই গানের প্রতি ভালো লাগা শুরু। মা ও বোনের অদম্য ইচ্ছায় গানের চর্চায় কখনো ভাটা পড়েনি। গত বছরের জুলাই মাসে বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকেও উৎসাহ পেয়ে যাচ্ছেন।

প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে দুই বোন গান গেয়ে শোনান

ফারহিমের বাবা বর্তমানে ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। মা, বোন, বোনের স্বামী ও ফারহিমের স্বামী সংসারটা আগলে রেখেছেন। তাঁরা সবাই একই ভবনের দুটো তলায়, অর্থাৎ কাছাকাছি বাসায় থাকেন। এতে ফারহিমের পাশেও সবাই থাকতে পারছেন।

ফারহিম তাঁর দুই পরিবারের সদস্যদের পাশে পেলেও ছোটবেলা থেকেই আত্মীয়দের কটু কথা শুনেছেন। কটু কথা শুনেছেন তাঁর মা–বাবাও।

ফারহিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শুনছি, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। আমি তো সংসারের বোঝা। আমার বিয়ে হবে না। বিয়ে হলেও সংসার করতে পারব না। আমার জন্য এত কষ্ট করে কী লাভ? তবে আমার পরিবার কখনোই আমাকে অবহেলা করেনি। বিশেষ করে মা আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। নিজে চাকরি করার পাশাপাশি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন পূরণে কখনো ক্ষান্ত হননি।’

ফারহিমের মুখে হাসি ফুটল। বলেন, ‘এখন শুধু আমার পরিবারই নয়, আগে যাঁরা আমাকে নিয়ে কটু কথা বলতেন, তাঁরাও এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। আমাকে নিয়ে অনেক ভালো কথা বলেন।’

ব্রেইল শিখেছিলেন মা

শুধু কটু কথা শোনাই নয়, পড়াশোনা এবং চলাফেরাতেও দৃষ্টিজয়ী মানুষদের প্রতি পদে প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়। তবে ফারহিমের পাশে পরিবারের সদস্যেরা থাকায় তাঁকে সংগ্রাম খানিকটা কম করতে হয়েছে। সে কথাই বলছিলেন তিনি, ‘আমার যাতে ব্রেইলে পড়াশোনা করতে সমস্যা না হয়, তাই মা নিজেও ব্রেইল শিখেছেন। পরীক্ষার সময় শ্রুতলেখক পাওয়া আরেকটা সংগ্রামের। প্রতিবারই শিক্ষকদের সহায়তায় এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। একা চলাফেরা করা তো আরও কঠিন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে (গণপরিবহন) চলাফেরা করা আতঙ্কের আরেক নাম।’

ফারহিমের নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ আছে। ফারহিমের স্বামী মূলত তাঁর পেজে একটি গান শুনেই ফারহিমের সঙ্গে সম্পর্ক করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। পারিবারিকভাবে পরে তা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়।

পরিবারের অন্য সদস্যের কথা

ফারহিমের স্বামী মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চারপাশের নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে একজন মেয়ে এত সুন্দর গান গায়, তা ছিল আমার প্রথম ভালো লাগার জায়গা। এই সমাজে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী একজন নারীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ নয়। আমাকেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে।’

‘আত্মীয়স্বজন নানা কথা বললেও আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। আমি সব সময় আমার স্ত্রীর পাশে থাকতে চাই। তাঁর যেকোনো সহায়তা লাগলে তা দেওয়ার চেষ্টা করব। আমি চাই, শুধু দেশে নয়, তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বেও’, বলেন মশিউর।

মশিউর জানান, ফারহিমের প্রযুক্তি নিয়ে খুব ভালো জানাশোনা। তিনি যেসব জায়গায় আটকে যান, সেখান থেকে ফারহিমই উদ্ধার করেন তাঁকে। কোনো জায়গা একবার ঘুরিয়ে দেখালে তা মনে রাখতে পারেন, দ্বিতীয়বার সে জায়গায় গিয়ে কোনো সমস্যা হয় না ফারহিমের। একজন স্ত্রী স্বামীর প্রতি যতটুকু দায়িত্ব পালন করেন, ফারহিমও তা করেন।

প্রথম আলো কার্যালয়ে স্বামী মশিউর রহমানের সঙ্গে ফারহিম

বড় বোন ফারিহা আঞ্জুম বলেন, ‘ফারহিম পরিবারের সহায়তা পেয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা মেধা এবং গানের প্রতি অদম্য ইচ্ছাই ওকে আজ এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। মা বাংলাদেশ টেলিভিশনে আছেন, তাই অনেকে স্বজনপ্রীতির কথা বলেন। এটা জোর দিয়েই বলা যায়, বেশির ভাগ মানুষ জানেনই না যে মা সেখানে কর্মরত। ফারহিমের সেখানে গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পেছনে মায়ের কোনো ভূমিকা নেই।’

এদিকে ফারহিম বলেন, ‘আমি চোখে দেখি না, তবে মনের চোখ দিয়ে সবই উপলব্ধি করতে পারি। একটু ভিন্নভাবে হলেও আমিও সব কাজ করতে পারি। আমি নিজেকে অন্যদের চেয়ে কোনোভাবেই অক্ষম মনে করি না। আমি চাই, সারা বিশ্বে আমার গান ছড়িয়ে পড়ুক। আর গানকে আমার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা দিয়ে কেউ বিচার করবেন না, এটাই আমার চাওয়া।’