তিন ছাত্রলীগ নেতা আহত

থানায় নিয়ে ওসির কক্ষে এডিসির নেতৃত্বে মারধর

অতীতেও শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও বিরোধীদের ওপর হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুলিশের এডিসি হারুন।

হারুন অর রশিদ
হারুন অর রশিদ

ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছে রাজধানীর শাহবাগ থানায়। আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা তাঁদের খোঁজ নিতে গেলে তাঁকেও মারধর করা হয়।

ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, শাহবাগ থানার ওসির (তদন্ত) কক্ষে গত শনিবার রাতে এই মারধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের অন্য নেতা-কর্মীরা গিয়ে থানা থেকে আক্রান্ত নেতাদের উদ্ধার করেন।

পুলিশের মারধরের শিকার ছাত্রলীগের তিন নেতা হলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত আনোয়ার হোসেন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অন্যরা চিকিৎসা নিয়ে হলে ফিরে গেছেন। মারধরের এই খবর গতকাল সকালে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা–কর্মীরা ক্ষোভ জানান।

গতকাল দুপুরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এডিসি হারুনকে রমনা বিভাগ থেকে সরিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দাঙ্গা দমন বা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। সন্ধ্যায় জানানো হয়, তাঁকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘটনার জেরে এডিসি হারুন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আজিজুল।

এভাবে ব্যক্তিগত আক্রোশে কাউকে থানায় নিয়ে যাওয়া এবং ওসির (তদন্ত) কক্ষে বেদম মারধর করার এই ঘটনায় পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যদি এমন আচরণ করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ কী আচরণ করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

অবশ্য গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এডিসি হারুন ‘যতটুকু অন্যায় করেছেন, ততটুকু শাস্তি পাবেন’। পুলিশ হোক, যে-ই হোক, যে অন্যায় করে, তার শাস্তি অবশ্যই হবে।

ঘটনাটি তদন্তের জন্য গতকাল রাতে ডিএমপি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু ঘটনাটিতে এডিসি হারুন ও মারধরে জড়িত অন্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা না হওয়া, এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত না করে শুধু বদলি করায় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগ গতকাল বিকেল থেকে ঘটনার বিচার চেয়ে বিবৃতি দেওয়া শুরু করে। গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত বিবৃতি দেওয়া হল কমিটির সংখ্যা দাঁড়ায় ৯টিতে। এ ছাড়া বিচার চেয়েছে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগও। কোনো কোনো বিবৃতিতে এডিসি হারুনকে গ্রেপ্তারের দাবি করা হয়। যেমন ‘এডিসি হারুনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’ শিরোনামে বিবৃতিতে পুলিশের এই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার ও চাকরিচ্যুতির জন্য বাংলাদেশ পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ।

কী হয়েছিল

থানায় পুলিশের মারধরে মারাত্মক আহত ছাত্রলীগের নেতা আনোয়ার হোসেনকে শনিবার রাতেই রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল বিকেলে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হয়।

এর আগে গতকাল দুপুরে আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি জানান, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক তাঁর এলাকার বড় ভাই। তাঁদের বাড়ি গাজীপুরে। আজিজুল শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে তাঁকে (আনোয়ার) ঢাকার শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে যেতে বলেন। রাত আটটার দিকে তিনি সেখানে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন আজিজুল বারডেম হাসপাতালের হৃদ্‌রোগ বিভাগে রয়েছেন, যেটি হাসপাতাল ভবনের চারতলায় অবস্থিত। চারতলায় গিয়ে দেখেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক ও পুলিশের এডিসি হারুনের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। তখন তিনি ও ছাত্রলীগের আরও দুই নেতা তাঁদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন।

আনোয়ার বলেন, এডিসি হারুন একপর্যায়ে শাহবাগ থানার ওসিকে (তদন্ত) ফোন করে হাসপাতালে ডেকে নেন। তাঁর সঙ্গে আরও পুলিশ সদস্য আসেন। তাঁরা আজিজুল এবং ছাত্রলীগের দুই নেতা শরীফ আহমেদ ও মাহবুবুর রহমানকে মারধর করেন। পরে পুলিশ আজিজুলসহ ছাত্রলীগের ওই দুই নেতাকে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়।

আনোয়ারের ভাষ্য, ‘এরপর আমি ফোনে রমনা বিভাগের উপকমিশনারকে (মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন) মারধরের ঘটনাটি জানিয়ে শাহবাগ থানায় যাই। গিয়ে দেখি ওসি তদন্তের কক্ষে সবাইকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। এডিসি হারুন, ওসি তদন্তসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা মারধর করছেন। আমি (আনোয়ার) ওসি তদন্তের কক্ষে ঢুকতেই পুলিশ সদস্যরা আমার ওপর হামলা করেন। মুখে কিলঘুষি মারেন। একপর্যায়ে আমাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে লাথি মারতে থাকেন।’

খবর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা–কর্মী শাহবাগ থানায় যান। তাঁরা সেখান থেকে সংগঠনের তিন নেতাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।

থানায় এভাবে মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় তিনি থানায় ছিলেন না। তাঁর কক্ষে কাউকে নেওয়া হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছে পরিদর্শক–তদন্তের (ওসি–তদন্ত) কক্ষে।

ঘটনার পর গতকাল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা মন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার বিচার দাবি করেন।

ছাত্রলীগের নেতারা দাবি করেন, হাসপাতাল ও থানার ঘটনা তাঁরা মুঠোফোনে ভিডিও করেছিলেন। এডিসি হারুন মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে সব মুছে দেন। এ সময় হারুন পুলিশের পোশাক (ইউনিফর্ম) পরা ছিলেন না।

বারডেম ও শাহবাগ থানায় কী ঘটনা ঘটেছিল, তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল এডিসি হারুনের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা অনুসন্ধান করে বের করেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই ঘটনার সূত্রপাত রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে। তাঁর স্ত্রীও পুলিশ কর্মকর্তা। এই নারী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এডিসি হারুন সেখানে গিয়েছিলেন তাঁর সহকর্মী হিসেবে। হাসপাতালটি তাঁর আওতাধীন এলাকায় বলেই সেখানে যান তিনি।

সেখানে কী ঘটেছিল, জানতে চাইলে ওই নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা সবকিছু ইনফর্মড (জানেন)। এরপরও কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

আহত ছাত্রলীগ নেতাদের ভাষ্য, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হককেও পুলিশ মারধর করেছে। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। তাঁকেও ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল।

বিষয়টি নিয়ে জানতে আজিজুল হকের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রথম আলোর পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তাও (এসএমএস) পাঠানো হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি।

বিচার চান ছাত্রলীগ নেতার মা

পুলিশের মারধরে আহত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেনকে হাসপাতালে দেখতে গেছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতা-কর্মী। সেখানে তাঁরা এই ঘটনায় সাংবাদিকদের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

হাসপাতালে গতকাল দুপুরের পর গিয়ে দেখা যায়, ছেলে আনোয়ার হোসেনের পাশে বসে কাঁদছিলেন মা নাজমুর নাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে এডিসি ও ওসি নির্মমভাবে পিটাইয়েছেন। আমি তাঁদের বিচার চাই।’

আগেও হামলার নেতৃত্বে ছিলেন এডিসি হারুন

রমনা বিভাগের এডিসির দায়িত্ব পালনকালে এর আগেও বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের পেটানো, সাংবাদিকদের মারধর ও বিরোধীদের কর্মসূচিতে হামলা এবং সহকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে তখন পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গত ১৫ মার্চ সাংবাদিকদের মারধরের নেতৃত্বে ছিলেন এডিসি হারুন। নিউমার্কেট এলাকায় গত বছর এপ্রিলে ব্যবসায়ী-দোকানকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় এডিসি হারুনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সংঘর্ষ থামাতে যাওয়া এক পুলিশ কনস্টেবল ‘গুলি শেষ হয়ে গেছে’ বলায় এডিসি হারুন তাঁকে চড় মেরেছিলেন। ওই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের মশাল মিছিলে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে হামলা হয়।

‘এখন ছাত্রলীগও রেহাই পাচ্ছে না’

এদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের ঘটনায় বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলও গতকাল বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে। সংগঠনটি অতীতের পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় এডিসি হারুনকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানায়। তবে ছাত্রদল বলেছে, ১৫ বছর ধরে পুলিশের সহযোগিতায় ছাত্রলীগ সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

ছাত্রলীগের নেতাদের শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম পেটানোর ঘটনায় জড়িত হারুন অর রশিদকে পুলিশ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিতে গত রাতে বিবৃতি দিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শিমুল কুম্ভকার ও সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী। তাঁরা বলেছেন, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন স্বার্থে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন যখনই ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়েছেন, প্রতিবারই ছাত্রলীগ তাতে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে, সরাসরি সহায়তাও করেছে। আজ তাদের নেতাদেরও এর শিকার হতে হচ্ছে।

বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলছেন, পুলিশের কোনো কর্মকর্তার অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের মারধর সেটারই উদাহরণ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘থানায় নির্যাতন আগেও হয়েছে, এখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। এ ঘটনা প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি না থাকার আরেকটি উদাহরণ।’