জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেওয়া সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে ১০ বার।
বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ টন।
বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ লাখ টন।
নতুন পরিশোধনাগার হলে উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টন।
বছরে সাশ্রয় করা যাবে ২৪ কোটি ডলার।
৪ বছর ৯ মাসে উঠে আসবে বিনিয়োগ।
দেশে জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা না বাড়ায় বেশি পরিমাণে ডিজেল আমদানি করতে হয়। এতে প্রতিবছর বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। এখন চাপে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ে আমদানি কমানোর চেষ্টা চলছে। অথচ ৫০ বছরেও দেশে তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়েনি। এর মধ্যে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নেওয়া প্রকল্পটি ১০ বছরেও অনুমোদিত হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে প্রায় ২৪ কোটি ডলার সাশ্রয় হতো। এখন বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেল পরিশোধনক্ষমতা বাড়াতে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল-২’ নামের প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালে। এরপর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ১০ বার সংশোধন করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে এটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা আছে।
দেশে একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) তৈরি করা হয় ১৯৬৮ সালে। বিপিসির মাধ্যমে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল তারা শোধন করে। এতে উৎপাদিত ডিজেলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেল নেয় বিপিসি। ইআরএলের বছরে তেল শোধনের সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। ইআরএল-২ প্রকল্পের আওতায় নতুন পরিশোধনাগারের সক্ষমতা হবে ৩০ লাখ টন। প্রকল্পটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিলে ঠিকাদার নিয়োগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। ঠিকাদার নিয়োগের পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে শোধনাগারটি স্থাপন করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সরকারি-বেসরকারি কোনো খাতেই সক্ষমতা বাড়েনি। জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়াতে ইআরএল-২ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হতো।ম তামিম, জ্বালানি–বিশেষজ্ঞ
বিপিসি ও ইআরএলের কর্মকর্তারা বলছেন, সময়মতো ইআরএল-২ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। পরিশোধন সক্ষমতার সঙ্গে মজুতক্ষমতাও বেড়ে তিন গুণ হতো। এতে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি না করে পরিস্থিতি বুঝে অপেক্ষা করার সুযোগ পেত বিপিসি।
বিপিসি ও ইআরএল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিশোধনাগারটি নির্মাণ করেছিল ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান টেকনিপ। নতুন পরিশোধনাগার তাদের মাধ্যমে করার নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার। কারিগরি নকশা তৈরি করতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে টেকনিপের সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি।
নকশা তৈরি করতে তিন বছর সময় নেয় টেকনিপ। একই সময়ে টেকনিপ ও বিপিসির মধ্যে সমঝোতা চলে। পরিশোধনাগার নির্মাণের পর চালু করার আগেই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল টেকনিপ। এমন শর্ত মানতে রাজি নয় বিপিসির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু শর্তের বিষয়েও আপত্তি ছিল বিপিসির। এতে কাজটি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে গেছে টেকনিপ।
ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আগের পরিশোধনাগারটি টেকনিপ করায় এবারও তাদের দিয়ে কাজ করানোর লক্ষ্য ছিল। অনেক বেশি সুবিধা চেয়েছিল টেকনিপ। দেশীয় স্বার্থ রক্ষায় তাদের সব দাবি পূরণ করা যায়নি। তারা চলে যাওয়ায় কিছুটা দেরি হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
১০ দফা ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে ইআরএল-২ বাস্তবায়নে খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। শুরুতে এটি ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। চালুর পর মাত্র ৪ বছর ৯ মাসের মধ্যে এ টাকা উঠে আসবে বলে ডিপিপিতে বলা হয়েছে।
তবে শুরু থেকে বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এরপর সরকারের অর্থায়নের অপেক্ষায় থেকে কেটে যায় আরও কয়েক বছর। এখন বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
বিপিসি ও ইআরএলের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরে প্রকল্পটি জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। এবার পরিকল্পনা কমিশনে গেছে। শিগগিরই এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।
গত অর্থবছরে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে বিপিসি। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল। দেশের একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া গেছে ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়েছে। বিপিসি ও ইআরএল সূত্র বলছে, অপরিশোধিত তেল এনে ডিজেল উৎপাদন করা হলে ১ ব্যারেলে (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) সাশ্রয় করা যায় ১১ ডলার।
তার মানে ডলারের বর্তমান আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার (৯৪ টাকা) ধরে হিসাব করা হলেও প্রতি লিটার ডিজেলে সাশ্রয় হবে ৭ টাকা। তবে ইআরএলের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে ডিজেলের যে দাম, এ অবস্থায় দেশে পরিশোধন করা হলে লিটারে ১৫ টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব।
জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে ডিপিপি বলছে, বর্তমানে দেশের পেট্রোলিয়াম পণ্যের মাত্র ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে ইআরএল। দেশে প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করতে হলে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে না। জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাই ইআরএল-২ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
গ্যাসের উপজাত হিসেবে দেশি গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া কনডেনসেট ও আমদানি করা ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) পরিশোধন করে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা হয়। শোধন সক্ষমতা না বাড়ায় ডিজেল ও ফার্নেস তেলের মতো পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বাড়ছে প্রতিবছর।
এতে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে চাপে আছে বিপিসি। ৫ আগস্ট ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম।
বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পেট্রলের চাহিদা দেশেই পূরণ করা হয়। অকটেন ৪০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা আমদানি করে আনা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পরিবহনে ব্যবহৃত ডিজেল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেল। ইআরএলের নতুন শোধনাগার হলে ডিজেলের বড় চাহিদা দেশেই পূরণ করা যাবে এবং পেট্রল রপ্তানি করার সুযোগ তৈরি হবে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, একসময় বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার নির্মাণে কারও কারও আগ্রহ তৈরি হয়। তারাই সরকারি সক্ষমতা না বাড়ানোর পেছনে প্রভাব রাখতে পারে।
অথচ সরকারি-বেসরকারি কোনো খাতেই সক্ষমতা বাড়েনি। জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়াতে ইআরএল-২ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হতো।