ময়মনসিংহের বিনপাড়ার ইসকন মন্দিরে ফলসহ তমালগাছ
ময়মনসিংহের বিনপাড়ার ইসকন মন্দিরে ফলসহ তমালগাছ

মহাবিপন্ন তমালগাছ

চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে গিয়েছিলাম বিনপাড়ার ইসকন মন্দিরে। ওখানে সর্বতীর্থ পরিক্রমা অঙ্গনের দক্ষিণ পাশে পেয়ে গেলাম তমালতরুর দেখা।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

‘কোন্‌ তমালের কাননতলে মধ্যদিনের তাপে

বনচ্ছায়ার শিরায় শিরায় তোমারি সুর কাঁপে।’

তমাল মাঝারি আকারের বৃক্ষ। এটি বনগাব, মহেশকাণ্ড ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তমালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Diospyros cordifolia, এটি Ebenaceae পরিবারের সদস্য। এর আদি নিবাস মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের উষ্ণ অঞ্চল। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও চীনেও তমালগাছ রয়েছে। ঢাকার রমনা পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে কয়েকটি অপরিণত গাছ আছে। বেনাপোল পাঠবাড়ী আশ্রম, ঠাকুরগাঁও গোবিন্দজীউ মন্দির, দিনাজপুর রাজবাড়ী কালিয়া কান্তজীউ মন্দির প্রাঙ্গণে এ গাছ রয়েছে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের কাছে যাওয়ার আগে পথের বাঁ পাশে মহাদেবের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি তমালগাছ। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রতীরের জয়নুল উদ্যানের প্রবেশপথের পূর্ব পাশে এবং কাচিঝুলিতে বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ের উল্টো দিকে একটি তমালগাছ রয়েছে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতি সংরক্ষিত। এটি একটি মহাবিপন্ন উদ্ভিদ।

বৈষ্ণব কবিতা, লোকগীতিতে তমাল মর্যাদার সঙ্গে আসীন। তমালগাছের বাকলের রং কালো আর কৃষ্ণের গায়ের রংও কালো, তাই তমাল শ্রী রাধারও প্রিয়।

‘না পুড়াইও রাধার অঙ্গ

না ভাসাইও জলে,

মরিলে বাঁধিয়া রেখো

তমালেরই ডালে’

তমালের কাণ্ড খাটো, ঘনকালো গিঁটযুক্ত। এর শাখা–প্রশাখা ছড়ানো এবং ছত্রাকৃতির। উদ্ভিদ চিরসবুজ, পত্রঘন। তমাল খুব ধীরে ধীরে বাড়ে। অনেক দিন লাগে বড় হতে। এর পাতা একান্তর, ৩.৮-১৪ সেমি লম্বা, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার, পাতার গোড়ার দিকটা গোলাকার। বসন্তে তমালগাছে ছোট ছোট সাদা সাদা ফুল ফোটে। ফুলগুলো সুগন্ধযুক্ত। তমালের ফুল আকারে বেশ ছোট ও সাদা রঙের। তমালের ফল গোলাকার, ২.৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা, পাকলে লালচে বাদামি রঙের হয় এবং গাবের মতোই বৃতিযুক্ত। ফল বিষাক্ত। গ্রীষ্মকালে ফল পাকে। কাঠ লালচে হলুদ, দৃঢ়।

অনেকে ভুল করে ডেফলকে তমাল ফল বলে মনে করেন। এটা মারাত্মক ভুল। ডেফলের বৈজ্ঞানিক নাম Garcinia xanthochymus, ডেফল খাওয়া যায় আর স্বাদ অম্লমধুর।

তমালের ফুল ফোটার সময় মার্চ-এপ্রিল। তমালের ফল দেখতে ছোট গাবের মতো গোল, পাকলে কিছুটা হলদে রঙের হয় গাবের মতোই। তাই একে বনগাবও বলে। এই ফল বিষাক্ত।

তমালের পাতাচূর্ণ মাছের জন্য বিষ। তবে ভেষজ চিকিৎসায় এর নানাবিধ ব্যবহার আছে। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবে সমস্যা, নিউরালজিয়া, প্লুরিসি, মিনোরেজিয়া, প্রসব–পরবর্তী জ্বর, বিষাক্ত মাকড়সার কামড় ইত্যাদিতে তমালগাছের নানা অংশ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এর ছালের নির্যাসে প্রদাহবিরোধী ও জ্বররোধী উপাদান আছে। এর অ্যালকোহলিক নির্যাসে ইঁদুরের ক্যানসার নিরাময়ের গুণ আছে বলে পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাঠের রং লালচে-হলুদ রঙের এবং দৃঢ় ও শক্ত।

অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক