উদ্বিগ্ন ছিল সদ্য যুদ্ধবিজয়ী বাঙালি জাতি। দীর্ঘ ৯ মাস অস্ত্র হাতে মরণপণ সংগ্রামের সফল পরিণতির ভেতর দিয়ে নিজের করে একটি পতাকা, একটি স্বাধীন–সার্বভৌম দেশ পেলেও যাঁর নেতৃত্বে বীর সন্তানেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে, সেই অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হানাদার পাকিস্তানিদের কারাগারে। ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও বিজয়ের সেই আনন্দ যেন অপূর্ণই রয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে।
পরাজিত পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে গড়িমসি করছিল। ফলে দেশবাসীর উদ্বেগ বাড়ছিল। অবশেষে বিশ্বনেতাদের চাপে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। প্রিয় নেতাকে নিয়ে উদ্বেগ আর প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছিল ৫২ বছর আগের এই দিনে, স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঘুমন্ত নিরপরাধ বাঙালির ওপরে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় বর্বর গণহত্যা। তারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এর আগেই অবশ্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামের আহ্বান জানান। ঘাতক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখে। দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে তিনি মুক্তিলাভ করেন। পাকিস্তান থেকে তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। লন্ডনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথসহ অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকার দেন বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে। এরপর লন্ডন থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিশেষ বিমানে ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লি পৌঁছান। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান ও গণ৵মান্য ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য তিনি ভারতের নেতৃবৃন্দ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
স্বদেশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল বিমানবন্দরে। ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে স্বাধীন দেশের মাটিতে তিনি পা রাখেন। নেতাকে নিজেদের মধ্যে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশবাতাস মুখর করে তোলে। বিকেলে পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সংবর্ধনা সভায় ভাষণ দেন। সে সময়ের পত্রপত্রিকার বিবরণ অনুসারে প্রায় ১০ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল সংবর্ধনায়। তিনি সদ্য স্বাধীন দেশটিকে গড়ে তুলতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
বাসস জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের বিজয় পূর্ণতা লাভ করেছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ তথা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ‘‘স্মার্ট বাংলাদেশ’’ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখব।’
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, বেলা আড়াইটায় সমাবেশ শুরু হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে সকাল সাড়ে ছয়টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে।
এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।