ষাটোর্ধ্ব হোসনে আরার ছেলে জাবেদকে মঙ্গলবার মধ্যরাত দেড়টায় পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন হোসনে আরা সূত্রাপুরের হাজি আবদুল মজিদ লেনের বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন। পরে তাঁকে জানানো হয়, জাবেদকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। এরপর বুধবার বেলা ১১টার পর হোসনে আরা ছেলেকে একনজর দেখার জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সামনে আসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাবেদের স্ত্রী স্বপ্না খাতুন ও তার দুই সন্তান।
বেলা একটার পর জাবেদকে পুলিশের গাড়িতে করে থানা থেকে আদালতে আনা হয়। মানুষের ভিড়ে ছেলের মুখ তখন দেখতে পারেননি হোসনে আরা। এরপর ছেলের মুখ দেখার জন্য একবার তিনি ছুটে যান হাজতখানার ফটকের সামনে। কিন্তু জাবেদ তখন হাজতখানার ভেতরে। এরপর হোসনে আরাকে নিয়ে যাওয়া হয় আদালত ভবনের নিচতলায়।
হোসনে আরা বেলা দুইটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে ধোলাইখালে ব্যবসা করে। আর তাঁকে গভীর রাতে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। এখনো আমি ওর মুখ দেখতে পারলাম না।’ জাবেদের ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে জানিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি।
জাবেদকে গত জুন মাসে দায়ের করা সূত্রাপুর থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়নি। তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আবেদন করে পুলিশ। অপর দিকে জাবেদের জামিন চেয়ে আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী। জাবেদ আদালতের হাজতখানায় থাকা অবস্থায় বিকেলে তাঁর জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। সে সময় তাঁর বৃদ্ধ মা আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে যখন জামিন আবেদন নাকচ হয়, তখন হোসনে আরা আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বিকেল চারটার দিকে হোসনে আরা আবার চলে আসেন আদালত ভবনের নিচতলায় হাজতখানার মূল ফটকে। তখন গ্রেপ্তার হওয়া আরও অনেক বিএনপি নেতা–কর্মীর স্বজনেরাও সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন। তখন হাজতখানা থেকে প্রিজন ভ্যানে করে গ্রেপ্তার বিএনপি নেতাকর্মীদের কারাগারে নিয়ে যেতে থাকে পুলিশ। যখনই হাজতখানা থেকে একটি প্রিজন ভ্যান প্রধান ফটক দিয়ে আদালতের সামনে আসে, তখন হোসনে আরার নজর থাকে প্রিজন ভ্যানের দিকে। কয়েকটি প্রিজন ভ্যান আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে গেলেও জাবেদের দেখা পাননি মা। ছেলেকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। সন্ধ্যার আগে প্রিজন ভ্যানের ফাঁক গলে জাবেদের মুখ দেখতে পান হোসনে আরা। তখন চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তিনি। পরে স্বজনেরা ধরাধরি করে হোসনে আরাকে একটি রিকশায় তুলে বাসার দিকে রওনা হন।
জাবেদের স্ত্রী স্বপ্না খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না। কিন্তু পুলিশ তো ধরে নিয়ে গেছে। জামিন হয়নি। জেলখানায় চলে গেল।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাবেদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ৪২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
জাবেদের আইনজীবী লিখিতভাবে আদালতকে বলেছেন, সূত্রাপুর থানার নাশকতার পুরান যে মামলায় জাবেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই ঘটনায় তিনি জড়িত নন। কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকা সত্ত্বেও সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। হয়রানি করার জন্য পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। আর গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা সব সময় নিজেদের নিরপরাধ দাবি করেন।’
গত জুলাই মাসে দায়ের করা কদমতলী থানার মামলায় মাতুয়াইলের মুদিদোকানি বশির আহমেদকে গত মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকে বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়। অপরদিকে তাঁর জামিন চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী। আদালত জামিন না দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বশিরের আইনজীবী লিখিতভাবে আদালতকে বলেন, বশির কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। সন্দেহবশত তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বামীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার খবর পেয়ে রাতেই সেখানে ছুটে যান বশিরের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। বুধবার সকাল ১০টার দিকে কলেজপড়ুয়া মেয়ে আর স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে আসেন তিনি। বেলা দুইটার পর প্রিজন ভ্যানে করে বশিরকে হাজতখানায় নেওয়া হয়। তখনো বাবার দেখা পায়নি ছেলে ও মেয়ে। সন্ধ্যা ছয়টায়ও বশিরকে হাজতখানায় রাখা হয়েছিল।
বশিরের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী রাজনীতি করে না, দোকানদারি করে। অথচ আমার স্বামীকে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আমার ছেলে–মেয়ে সকাল থেকে অপেক্ষা করছে বাবাকে দেখার জন্য।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বশির আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বিএনপির কোনো পদে আছেন কি না, সেটি তদন্ত সাপেক্ষে বলা সম্ভব হবে।’
বশিরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে বলছিল, ‘আমার বাবা একজন দোকানদার। কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাবা জড়িত নন। তবু আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখন তিনি কারাগারে।’
সন্ধ্যার সময় প্রিজন ভ্যানে বশিরকে দেখার পর আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে। প্রিজন ভ্যান আদালতের ফটক ছেড়ে যাওয়ার পর কলেজপড়ুয়া মেয়েটি মা ও ভাইকে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হন।
ঢাকার নয়া পল্টনে বুধবার বিএনপির সমাবেশ ঘিরে গ্রেপ্তার বিএনপির ১৯৮ নেতা–কর্মীকে এদিন আদালতে হাজির করে পুলিশ।